রমজান, কোরআন এবং আমরা

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন 

রমজান মাস অন্য মাসের মত নয়
রমজান মাস অন্যসব মাসের মত সাধারণ কোন মাস নয়। এটি অত্যন্ত পবিত্র মাস, পূণ্যের মাস। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস মাহে রমজান। এই পুরো মাসটিই ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পূর্ণ। এই মাসেই পবিত্র কোরআন মজিদ নাযিল হয়েছে। তাই এই পবিত্র মাসে রোজা বা সিয়াম সাধনাকে আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন প্রত্যেক ঈমানদার নরনারীর উপর ফরজ বা বাধ্যতামূলক করেছেন। শুধু আল কোরআনই নয়, অন্যান্য প্রধান প্রধান আসমানি কিতাবও রমজান মাসেই নাযিল হয়েছিল এবং একারণে পূর্ববর্তী উম্মতদের উপরও রমজান মাসে সিয়াম সাধনা বাধ্যতামূলক ছিল। যেমন পবিত্র কোরআন মজিদে আল¬াহ রাব্বুল আ’লামীন স্বয়ং বলেন:

‘হে মু’মিনগণ! তোমাদের তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হইল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেওয়া হইয়াছিল, যাহাতে তোমারা মুত্তাকী হইতে পার।’ -[বাকারা : ১৮৩]

রমজান মাসের পুরো সময় রোজা রাখা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ বা মৌলিক ইবাদতের অন্যতম। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন: পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলামের বুনিয়াদ স্থাপিত। এগুলো হলো- ১.ঈমান- আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ’র রাসূল এই প্রত্যয় ব্যক্ত করা; ২. নামাজ কায়েম করা; ৩. যাকাত প্রদান করা; ৪. রমজান মাসের রোজা রাখা এবং ৫. বাইতুল্লা’য় হজ্জ করা।

রহমতের মাস

পবিত্র রমজান মাস রহমতের মাস। এ মাসে জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়। তাই এ মাসে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে এক পবিত্র ভাবধারা বিরাজ করে। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ এই পবিত্র মাসে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থেকে আল¬াহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেন। পবিত্র এ মাস হল মাগফিরাতের মাস, নাজাতের মাস। এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ রাখা হয় এবং প্রধা প্রধান শয়তানগুলোকে বন্দী রাখা হয়। তাই এ মাসে সাধারণভাবে ঈমানদারদের দিল নরম থাকে, তাদের হৃদয়, মন ও আত্মা আল্লাহ’র দিকে, মহান সৃষ্টিকর্তার দিকে রুজু থাকে।

পূণ্যের মাস

পবিত্র এই মাস অশেষ পূণ্যের মাস। মহানবী (সা.) শাবান মাসের শেষ দিন সাহাবীদের  উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে পবিত্র রমজান মাসের আগমন বার্তা ঘোষণা করে এই মাসকে এক মহিমান্বিত ও বরকতময় মাস হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এই মাসে এমন এক রাত রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। বলাবাহুল্য, এই রাতটির নাম ক্বদরের রাত। মহানবী জানিয়েছেন, এ মাসের শেষ দশ দিনের বেজোর রাত সমূহের মধ্যেই ক্বদরের রাত নিহিত থাকে। এই শেষ দশদিনে মুসলমানদেরকে এতেকাফে বসার জন্যও তাগিদ দিয়েছেন তিনি। গুনাহ মাফ এবং জাহান্নাম থেকে নাজাতের আশায় এ সময় মুসলমানরা মসজিদে মসজিদে এতেকাফ করে থাকেন। ক্বদরের রাত ছাড়াও এ মাসের প্রতিটি রাত, প্রতিটি দিন এবং প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত বরকতপূর্ণ। মহানবী (সা.) বলেছেন, এই পবিত্র মাসে যে একটি নফল ইবাদত করবে সে অন্য সময়ে একটি ফরজ ইবাদত করার সমান পূণ্য লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি এই মাসে একটি ফরজ আদায় করবে, সে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায়ের পূণ্য লাভ করবে। একারণেই বলছিলাম যে, পবিত্র এই মাস অন্য মাসের মত নয়। এই বরকতময় সময়ের একটি মুহূর্তও হেলায় হারানো উচিত নয়। বিশেষ করে ক্বদরের রাত তো নয়ই। মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ক্বদরের রাত থেকে বঞ্চিত হল তার মত হতভাগা আর নেই। তিনি আরো বলেছেন, রমজান মাসের প্রথম দশ দিন রহমতে পূর্ণ থাকে। দ্বিতীয় দশদিন ক্ষমা লাভ এবং শেষ দশ দিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের উপায়। তবে এ সবকিছুই নির্ভর করে এই পবিত্র মাসের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্যকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করার উপর।

সিয়াম ও আত্মসংযম

মনে রাখতে হবে, সিয়াম শুধু মাত্র সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে থাকার নাম নয়, বরং এটি রীতিমত একটি সাধনার নাম। রোজার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাক্বওয়ার গুণাবলী অর্জন করা। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহকে ভয় করে, ভালোবেসে চলা; তার আদেশ নিষেধ মেনে চলা। আত্মশুদ্ধি এবং স্রষ্টার নৈকট্য লাভ ছাড়া এই গুণাবলী অর্জন সম্ভব নয়। অনেককেই দেখা যায়, রোজা রাখা সত্বেও নামাজ পড়ে না, টেলিভিশন ও সিনেমা দেখে সময় কাটায়। এ থেকে বুঝা যায়, রোজার তাৎপর্য তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। মনে রাখতে হবে রোজা আর উপবাস/অনশন এক নয়। রোজা রেখে যদি খোদাভীতি অর্জন করা না যায় তাহলে কোন লাভ নেই। কারণ খোদাভীতি অর্জন করাই রোজার মূল উদ্দেশ্য, যা আমরা উপরে উল্লেখিত আয়াত থেকেই জানতে পেরেছি। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা কাজ থেকে বিরত থাকতে পারল না, তার রোজা রেখে পানাহার ত্যাগ করায় আল্লাহ্র কোন প্রয়োজন নেই।’ আল¬াহকে ভয় করে চলা মানে যেমন তাঁর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা তেমনি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তাঁর আদেশ পালন করা। নামাজ পড়া হল আল্ল¬াহ’র আদেশ। কোন অবস্থাতেই আল্লাহ’র এই আদেশ লঙ্ঘন করার সুযোগ নেই। রোজা রাখা অবস্থায় আল্লাহ’র এই আদেশ লংঘন করার কথা তো ঈমানদার ব্যক্তি চিন্তাই করতে পারেন না।

এ কারণে আত্মসংযমমফ হল রোজা রাখা বা সিয়াম সাধনার মূল কথা। সমস্ত লোভ, লালসা হারাম থেকে বেঁচে থাকা রমজানের বড় শিক্ষা। এজন্য যথেষ্ট সবর ও ধৈর্য্য প্রয়োজন। প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি সহনশীল হওয়া, সহমর্মিতা প্রকাশ করা। আমরা আমাদের দেশে আরেকটি উদ্ভট জিনিস দেখি। সেটি হল রমজান এলেই জিনিস-পত্রের দাম যেন হু হু করে বেড়ে যায়। এটি পৃথিবীর আর কোন মুসলিম দেশে দেখা যায় না। এটি কোন মতেই আত্মসংযমের মধ্যে পড়ে না। এছাড়া ইদানিং আমাদের দেশে নাগরিকদের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ ও সহিংসতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। রমজানের সঠিক চেতনা তথা ভ্রাতৃত্ববোধ, সহনশীলতা, ধৈর্য্যই আমাদেরকে এই সংকট থেকে রেহাই দিতে পারে।

মাহে রমজান হল কোরআন নাযিলের মাস। এ মাসেই পবিত্র কোরআন মজিদ নাযিল হয়। আল্লাহ্ বলেন: ‘রমজান সেই মাস, যে মাসে কোরআন নাযিল করা হয়েছে; যা সমগ্র মানব জাতির জন্য হেদায়াত, সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। তোমাদের মধ্যে যেই এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে, সে যেন রোজা রাখে।’ - আল বাকারা: ১৮৫। 
কাজেই এই মাসে আল্লাহ’র কালাম তেলাওয়াত করা, অধ্যয়ন ও উপলব্ধির মাধ্যমে সিরাতুল মুশতাক্বিমের সন্ধান করা আমাদের সকলের কর্তব্য।

রমজান মাস: কোরআনের মাস

রমজান মাস, কোরআনের মাস। পবিত্র এই মাসে মুসলমানদেরকে বেশি বেশি করে কোরআন পড়ার এবং নেক আমল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমরা মহানবীর (সা.) একটি হাদীস উল্লেখ করতে পারি। শাবান মাসের শেষ দিনে পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে মহানবী (সা.) সাহাবীদেও উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেন: ‘হে লোক সকল! একটি মহিমান্বিত মাস তোমাদের দ্বারে সমাগত। এই পবিত্র মাসে এমন একটি রাত রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এই মাসে দিনের বেলা রোজা রাখাকে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য বাধ্যতামূলক (ফরজ) করেছেন এবং রাতের বেলা নামাজ পড়াকে (তারাবীহ) তোমাদের জন্য করেছেন ঐচ্ছিক। তবে এই মাসে আল্লাহর  নৈকট্য লাভের আশায় যে একটি ঐচ্ছিক (নফল) আমল করবে সে অন্য মাসের একটি ফরজ আমল করার সমান সওয়া (পূণ্য) লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি এই মাসে একটি ফরজ আদায় করবে, সে অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায় করার সমান সওয়াব লাভ করবে। আর এ মাসটি হল সবরের মাস এবং সবরের পুরুষ্কার হল জান্নাত। এছাড়া এ মাসটি হল দান-খয়রাত ও সেবার মাস। এটি এমন বরকতময় মাস, যে মাসে বিশ্বাসীদের রিজিক বৃদ্ধি পায়। রমজান মাসে যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার করাবে তার গোনাহ মাফ করা হবে, দোযখের আগুন থেকে সে মুক্তি পাবে এবং রোজাদার রোজা রেখে যে সওয়াব পাবে, সেও তার মত সমান সওয়াব পাবে; তবে তাতে রোজাদারের সওয়াব একটুও নষ্ট হবে না।

ইউ কে শরীয়াহ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান শেখ সাইয়েদ আদ দারস রমজান মাসকে কোরআনের মাস বলে ফতোয়া দিয়েছেন। তিনি বলেন, রমজান মাস কোরআনের মাস। কারণ, এ মাসেই কোরআন নাযিল হয়েছে। স্বয়ং আল¬াহ রাব্বুল আ’লামীন এ প্রসঙ্গে ঘোষণা করেছেন: ‘রমজান সেই মাস, যে মাসে কোরআন নাযিল করা হয়েছে; যা সমগ্র মানব জাতির জন্য হেদায়াত, সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। তোমাদের মধ্যে যেই এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে, সে যেন রোজা রাখে।’ - আল বাকারা: ১৮৫

তিনি আরো বলেন, পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটি পবিত্র রমজান এবং মহাগ্রন্থ আল কোরআনের মধ্যেকার সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আমরা জানি, মহানবী (সা.) নবুওয়ত লাভের পূর্বে রমজান মাসে হেরা গুহায় ধ্যান করতেন। সেখানে ধ্যানরত অবস্থায় ক্বদরের রাতে আল্লাহ’র নির্দেশে ফেরেশতা জিবরিল (আ.) মহানবীর নিকট সর্ব প্রথম  সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত নাযিল করেন। এর মাধ্যমে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির, আরশের সাথে মর্ত্যরে মানুষের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয়। এটি মানব ইতিহাসে এক বিরাট ঘটনা। এ কারণেই রমজান মাস কোরআনের মাস। স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক স্থাপনের মাস।

দ্বিতীয়ত: যখন থেকে রমজান মাসের রোজা রাখা বাধ্যতামূলক বা ফরজ করা হয়, তখন থেকেই আল্লাহর রাসূল (সা.) প্রতিটি রমজান মাসে ফেরেশা জিবরিল (আ.)-কে সাথে নিয়ে কোরআন খতম করতেন। জিবরিল আ. কোরআন তেলাওয়াত করে নবীকে শোনাতেন এবং আল্লাহর রাসূলও কোরআন তেলাওয়াত করে জিবরিল আ.কে শোনাতেন। রমজান মাসের প্রতি রাতে এ ঘটনা ঘটত।

মহানবীর কন্যা হযরত ফাতিমা (রাঃ) বলেন, যে বছর মহানবী (সা.) ইন্তেকাল করেন সে বছর তিনি দু’বার কোরআন খতম করেন।

তৃতীয়ত: তারাবীহ’র নামাজের মাধ্যমে পুরো মাসে একবার কোরআন খতম করার জন্য মুসলমানদেরকে বলা হয়েছে। যার কারণে প্রতি বছর রমজান মাসে বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা তারাবীহ নামাজের মাধ্যমে কোরআন খতম করে আসছেন।

পবিত্র রমজান মাসকে বলা হয় কোরআনের মাস। এ মাসের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব বর্ণনা করতে যেয়ে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেছেন:

‘রমজান সেই মাস, যে মাসে কোরআন নাযিল করা হয়েছে; যা সমগ্র মানব জাতির জন্য হেদায়াত, সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। তোমাদের মধ্যে যেই এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে, সে যেন রোজা রাখে।’ - আল বাকারা: ১৮৫

মহানবী হযরত মুহাম্মদের বয়স যখন চল্লিশ বছর পূর্ণ হয় তখন রমজান মাসের ক্বদরের রাত্রিতে প্রথম অহী নাযিল হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ’নিশ্চয়ই আমরা এ কোরআনকে ক্বদরের রাতে নাযিল করেছি। তুমি কি জানো ক্বদরের রাত কী? ক্বদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।’ - সূরা আল ক্বদর: আয়াত ১-৩)। এছাড়া সূরা দুখানেও বলা হয়েছে : জেনে রাখো, আমরা এই কোরআনকে নাযিল করেছি এক মহিমান্বিত রাতে।’ -(দুখান: ৩)

আমরা জানি, সমগ্র কোরআন মহানবীর (সা.) তেইশ বছরের নবুওয়তি জিন্দেগীতে প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে নাযিল হয়েছিল, কিন্ত তার আগে সমগ্র কোরআন একসাথে লাওহে মাহফুজে সংরক্ষণ করা হয় এবং তাও করা হয়েছিল ক্বদরের রাত্রিতেই।

রোজার মূল উদ্দেশ্য

প্রতিটি কাজেরই একটি উদ্দেশ্য থাকে।নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত এসব মৌলিক ইবাদত সমূহেরও উদ্দেশ্য রয়েছে।আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন উদ্দেশ্য ছাড়া যেমন কোন কিছু সৃষ্টি করেননি, তেমনি কোন বিধানও প্রদান করেননি।রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তায়া’লা ঘোষণা করেছেন:

‘হে ঈমান্দারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর; যাতে তোমারা মুত্তাকী (খোদাভীরু) হতে পারো।’ -[বাকারা : ১৮৩]

‘আল্লাহ'র ভয়’ বা ‘তাক্বওয়া’ ইসলামের একটি মৌলিক পরিভাষা শুধু নয়, কেন্দ্রিয় ভাবধারা। এটি মানুষের সমস্ত কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক এবং ইসলামী নৈতিকতার প্রাণশক্তি। আল্লাহ'র ভয় ছাড়া কোন ব্যক্তির পক্ষেই নিরংকুশভাবে নৈতিকতার আদর্শকে সমুন্নত রাখা সম্ভব নয়। সমাজ ও লোক-চক্ষুর সামনে যে কেউ-ই ভাল মানুষ সাজার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ'র ভয় না থাকলে এসব লৌকিক পাহারার অনুপস্থিতিতে নৈতিক আদর্শকে বজায় রাখা কারো পক্ষেই সম্ভব হয় না। তখন পদে পদে নফস-প্রবৃত্তির সাথে আপোষ করতে আর কারো দেরি হয় না। এ কারণে আল্লাহ'র ভয় মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

ইসলামের একটি কেন্দ্রিয় বিষয় হওয়ার কারণেই আল্লাহ'র ভয় বা পরহেজগারী সম্পর্কে যথার্থ ধারণা থাকা জরুরী। আল্লাহকে ভয় করতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি কাজে, শুধু মাত্র কোন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নয়। আল্লাহ  আমাদের ভিতরের-বাইরের, আমাদের মনের প্রতিটি খবরই জানেন। প্রতি মুহূর্তেই আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, তিনি আমাদের সবকিছু দেখছেন এবং প্রতিটি কাজের জন্যই আমাদেরকে তাঁর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ  বলেছেন :

‘হে নবী! লোকদের সতর্ক করে দাও যে, তোমাদের মনে যা কিছু আছে, তা গোপন করা কিংবা প্রকাশ কর, আল্লাহ তার সব কিছুই জানেন। আসমান ও জমিনের কোন জিনিসই তাঁর জ্ঞানের আওতার বাইরে নয় এবং তাঁর ক্ষমতা-কর্তৃত্ব প্রতিটি বস্তুকেই পরিবেষ্টন করে আছে।’ -[আলে ইমরান : ২৯]

আল্লাহ'র ভয় বা তাক্বওয়ার গুণ অর্জন ছাড়া প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে এক আল্লাহ'র দাসত্ব বা গোলামী করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি আল কোরআন থেকে হেদায়াত লাভ বা ইসলামী জিন্দেগী যাপনও সম্ভব হবে না। এ কারণে আল কোরআনের দ্বিতীয় সূরা আল বাকারার শুরুতেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই কিতাব মুত্তাক্বীদের জন্য হেদায়াত। অর্থাৎ এই কিতাব থেকে হেদায়াত লাভ করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই মুত্তাকী বা তাক্বওয়ার গুণাবলী অর্জন করতে হবে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আল্লাহ'র  আনুগত্যের মতই আল্লাহ'র ভয়কেও আমরা একটি বিশেষ টাইপের মধ্যে সীমিত করে ফেলেছি। আসলে আল্লাহ'র আনুগত্য যেমন শুধুমাত্র উপাসনার চার দেয়ালের মধ্যে সীমিত নয়, বরং জীবনের সর্বক্ষেত্রে; লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে বিস্তৃত; তেমনি আল্লাহ'র  আনুগত্যের সাথে আল্লাহ'র ভয়ের প্রশ্নটিও জড়িত। জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমরা আল্লাহ  রাব্বুল আ’লামীনকে কতটুকু যথার্থ ভয় করছি তা নির্ভর করবে আমাদের অন্তরে আল্লাহ'র  ভয় কতটুকু আছে তার উপর। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণীর লোক আছেন যারা নিজেদেরকে অত্যন্ত পরহেজগার বলে মনে করেন। অথচ তারা এই পরহেজগারীকে শুধুমাত্র একটি বিশেষ টাইপের পোষাক, নির্দিষ্ট মাপের দাড়ি এবং কিছু আনুষ্ঠানিকতার ফ্রেমে বন্দী করে ফেলেছেন। তারা আমাদের পবিত্র ধর্ম এবং এর মূল স্পিরিটকে একটি বিশেষ টাইপ আর আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দী করে সমাজ কাঠামো এবং সভ্যতা-সংস্কৃতি-রাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত খোদাবিমুখ ফাসেক, স্বেচ্ছাচারী ও ধর্মদ্রোহী তাগুতি শক্তির হাতে তুলে দিয়েছেন এবং সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদেরই অন্ধ অনুসরণ করে চলেছেন। আসলে ঈমানদারী আর পরহেজগারীর আসল পরীক্ষার মুখোমুখি হই আমরা আমাদের বাস্তব কর্মক্ষেত্রে, আমাদের শিক্ষা-সভ্যতা-সংস্কৃতি-রাজনীতির কঠিন ময়দানে। এই কঠিন ময়দানের পরীক্ষা ক্ষেত্রে এসে তখন অনেক প্রাতিষ্ঠানিক ধার্মিককেই দেখা যায় আল্লাহ'র  পরিবর্তে বাতিলকেই বেশি ভয় করতে কিংবা বেশি মহব্বত করতে। আসলে এটাও এক প্রকার সুবিধাবাদ বা নফসিনিয়াত।

রমজান মাস এমন এক মাস, যে মাসে শত কষ্ট সত্বেও আমরা দিনের বেলায় জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় খাদ্য-পানীয় গ্রহণ এবং শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন থেকে বিরত থাকি। বিগত এগারো মাসে আমরা সাধারণত আত্মিক চাহিদার চেয়ে দৈহিক চাহিদা ও কামনা-বাসনাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। সে সময় আমরা যথাযথভাবে আল¬াহর ইবাদত-বন্দেগী করা বা হুকুম আহকাম পালন করা হয়ে ওঠেনা। সে সময় আমরা প্রবৃত্তির তাড়নায় কিংবা লোভ-লালসার কারণে এমনসব কাজও করে ফেলি যা করা আমাদের মোটেও উচিত ছিল না। বলা যায় আমরা প্রায় সারা বছরই গাফলতির মধ্যে ডুবে থাকি, আমাদের কুপ্রবৃত্তিগুলো প্রবল হয়ে ওঠে এবং আল¬াহর নৈকট্য থেকে অনেক দূরে সরে যাই। কিন্তু এটা কোন ঈমানদারীর বৈশিষ্ট হতে পারে না। ঈমানদারী আর প্রবৃত্তির গোলামী একসাথে চলতে পারে না। বরং একজন মুমিন-মুসলমানের কাজ হল সমস্ত লোভ-লালসা তথা কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করে চলা। এটা মুমিনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। যদিও কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানের কুমন্ত্রণা, বৈরী পারিপার্শিকতার কারণে এই চ্যালেঞ্জের যথাযথ মোকাবেলা করতে পারি না। কিন্তু মাহে রমজান হল কুপ্রবৃত্তির উপর সুপ্রবৃত্তিকে বিজয়ী করার মাস, আত্মসংযমের মাস। এ মাসে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন আমাদের দৈহিক ও জৈবিক চাহিদাকে সীমিত করে দিয়েছেন যাতে আমরা বস্তুগত চাহিদার তুলনায় নৈতিক বা আত্মিক চাহদিাকে প্রাধান্য দিতে পারি। বস্তুত: এটি হল আধ্যাত্মিক উন্নয়নের এক ধারাবাহিক সাধনার মাস, যাতে বছরের বাকি মাসগুলোতে আমরা ঈমানদারীর বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলতে পারি।

আত্মশুদ্ধি এবং বিবেকবোধ

মানুষের স্বভাবের মধ্যে ভাল-মন্দ বুঝার একটি স্বাভাবিক বোধ বা বিবেক আল্লাহ দিয়ে দিয়েছেন। এই বিবেক বা সুপ্রবৃত্তি মানুষের প্রকৃতিতে সহজাত। বিবেক বা সুপ্রবৃত্তি সব সময়ই মানুষের সৎ বৃত্তির বিকাশ কামনা করে, মানুষকে সৎ পথে চালিত করে। এ বোধ বা বিবেককে কেউ কেউ নীতিবোধ বা চৈতন্যও বলেছেন। ইসলাম এরই নাম দিয়েছে ক্বালব, অন্তর বা হৃদয়। মানুষ যখন খারাপ কাজ করে তখন তার বিবেক তাকে দংশন করে। আর যখন ভালো কাজ করে তখন বিবেক স্বস্তি পায়। মহানবী (সঃ) বলেছেন - “যে কাজে তোমার মন স্থিতি লাভ করে এবং যে কাজে হৃদয় বা বিবেক স্বস্তি ও নিশ্চয়তা পায় তাই পূণ্য বা সুনীতি। পক্ষান্তরে যে কাজে তোমার মন স্থিরতা পায় না এবং বিবেক স্বস্তি পায় না তাই পাপ বা দুর্নীতি।” 

মানুষের প্রকৃতি বা নফসের মধ্যে এই বিবেকবোধ আল্লাহই দিয়ে দিয়েছেন। যেমন সূরা আশ্ শামস্ -এ বলা হয়েছে :

‘কসম মানুষের নফসের (প্রবৃত্তির) এবং কসম সেই সত্তার যিনি তাকে সঠিকভাবে গঠন করেছেন, তারপর তার উপর পাপ ও নৈতিক বোধ ইলহাম করেছেন।’ [সূরা আশ শামস : ৭-৮]

আল কোরআনে মানুষের নফসের তিনটি রূপের কথা বলা হয়েছে। একটি নফস হল যা মানুষকে সব ধরনের অন্যায় ও দুস্কৃতির কাজে উস্কানি দেয়। একে বলা হয় ‘নফসে আম্মারা’। দ্বিতীয় ধরনের নফস হল যা ভুল বা অন্যায় কাজ করলে, অন্যায় ও ভুল কথা চিন্তা করলে বা খারাপ নিয়ত বা মন-মানসিকতা পোষণ করলে মানুষকে লজ্জিত ও অনুতপ্ত করে, ভিতর থেকে মানুষকে তিরষ্কার করে। এর নাম হল ‘নফসে লাউয়ামা’। আমরা একে ‘বিবেক’ও বলতে পারি। তৃতীয় হল সেই নফস, যা সত্য-সঠিক পথে চলা ও ভুল বা অন্যায় পথ পরিহার করার দরুন অন্তরে স্বস্তি ও নিশ্চিন্ততা অনুভব করে। এর নাম হলো ‘নফসে মুতমায়িন্না’। 

মানুষের প্রতি তার পাপ এবং তার নেকী ও তাকওয়া ইলহাম করে দেয়ার দুটি অর্থ হয়। এক, স্রষ্টা তার মধ্যে নেকী ও গোনাহ উভয়ের ঝোঁক প্রবণতা রেখে দিয়েছেন। প্রত্যেক ব্যক্তিই এটি অনুভব করে। দুই, প্রত্যেক ব্যক্তির অবচেতন মনে আল¬াহ এ চিন্তাটি রেখে দিয়েছেন যে, নৈতিকতার ক্ষেত্রে কোন্ জিনিস ভাল এবং কোন জিনিস মন্দ এবং সৎ নৈতিক বৃত্তি ও সৎকাজ এবং অসৎ নৈতিক বৃত্তি ও অসৎকাজ সমান নয়। ফুজুর (দুস্কৃতি ও পাপ) একটি খারাপ কাজ এবং তাকওয়া (খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকা) একটি ভাল কাজ, এ চিন্তাধারা মানুষের মধ্যে নতুন নয়।

বস্তুবাদী দর্শন মানুষকে শুধুমাত্র জৈববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির সমষ্টি মনে করলেও ইসলাম তা মনে করে না। শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির কারণেই মানুষ ইতরতার উর্ধ্বে উঠতে পারে না। বরং বুদ্ধির জোরে মানুষ এমন উম্মত্ত ও পাশবিক আচরণও করতে পারে যা কোন ইতর প্রাণীর পক্ষেও সম্ভব হয় না। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের প্রধান পরিচয় হল তার নৈতিক সত্তায়। অর্থাৎ, যে সত্তাটি মানুষকে ইতর প্রাণী থেকে পৃথক ক’রে তাকে স্বাতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে তা তার নৈতিকতা বা বিবেক। জন্মগতভাবেই আল্লাহ মানুষের ফিতরাৎ বা স্বভাব-প্রকৃতিতে এটি দিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন -‘আর না, আমি কসম করছি (মানুষের মধ্যেকার) নফসে লাওয়ামার (বিবেক) যা তাকে তিরষ্কার করে।-[আল কিয়ামাহ : ২]

মানুষের এই নৈতিকতা, বিবেক বা চরিত্রেরই অপর নাম হল মনুষ্যত্ব। মনুষষ্যত্ব বা বিবেকবোধের কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা বা আশরাফুল মাখলুকাত। কিন্তু মনুষ্যত্ব হারিয়ে গেলে মানুষের সবই হারিয়ে যায়। তখন তার আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না বরং তার চেয়েও নীচে নেমে যায়। এ কথাটিই সূরা আত্ তীনে এভাবে বলা হয়েছে :

‘আমি মানুষকে তৈরি করেছি সর্বোত্তম কাঠামোয়। আবার তাকে ফিরিয়ে নীচতমদেরও নীচে পৌছে দিয়েছি। তাদেরকে ছাড়া; যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করতে থাকে।’ [৪-৫]

মানব সত্তার এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই পৃথিবীতে মানুষের পথ আর অন্যান্য মানবেতর প্রাণীর পথের মত হতে পারে না। মানুষের জীবনোপকরণ, তাদের চাহিদা ও প্রয়োজনও তাই নিছক অন্য সব প্রাণীর মত শুধুমাত্র বস্তুগত ও জৈবিক চাহিদার মধ্যেই সীমিত থাকতে পারে না। মানুষ যেহেতু বোধহীন নয়, সেহেতু তার জীবনও অন্যান ইতর ও অবোধ প্রাণীর মত গতানুগতিক, উদ্দেশ্যহীন হতে পারে না। বরং যেহেতু মানুষকে ঘোষণা করা কয়েছে খোদার খলিফা, যেহেতু তাকে দেয়া হয়েছে বুদ্ধি-বিবেক ও একটি উন্নত নৈতিক সত্তা সেহেতু পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজনেও পরম করুণাময়ের রয়েছে একটি বিশেষ আয়োজন। ধর্ম সেই প্রয়োজন পূরণেরই অনিবার্য দাবী।

ইসলাম তাই মানুষের এই মনুষ্যত্ব বা বিবেকের পূর্ণ বিকাশ চায়। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন বলেছেন :‘নিঃসন্দেহে সফল হয়েছে সে ব্যক্তি যে তার নফসকে পরিশুদ্ধ করেছে আর ব্যর্থ হয়েছে সে ব্যক্তি -যে তাকে দাবিয়ে রেখেছে।’[আশ্শামস:৯-১০]’ ; ‘সফল হয়েছে সে ব্যক্তি যে পবিত্রতা অবলম্বন করেছে।’ -[আ’লা : ৪]

 মহানবী (সঃ) বলেছেন: ‘নৈতিক চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্যই আমি আবির্ভূত হয়েছি।’

“হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই একজন মুমিন ব্যক্তি তার উত্তম চরিত্রগুণে সেসব আবেদ লোকের মর্যাদা লাভ করতে পারে, যারা সারা রাত নামাযে কাটায় আর সারা বছরই রোযা রাখে।” -[আবু দাউদ]

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সবচেয়ে উত্তম, যে চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম।” -[বুখারী, মুসলিম]

নফস বা প্রবৃত্তির গোলামীর ব্যাপারে হুশিয়ারী

মানুষ যখন নফসের গোলাম বা প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়ে তখন তার বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায়। নফসের গোলামী ঈমানদারী আর আত্মশুদ্ধির পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা। কাজেই আল্লাহর পরিবর্তে যারা প্রবৃত্তিকেই নিজেদের প্রভু বানিয়ে নিয়েছে ঐশী কালাম থেকে তারা কোন ফায়দাই হাসিল করতে পারে না। যারা নফসের গোলাম তারা তো মনুষ্যত্বের কলংক। ইতর প্রাণী আর তাদের মধ্যে কার্যত কোন পার্থক্য নেই। যারা নফসের গোলাম হয়ে পড়ে, আল্লাহর কালামের ইজ্জত তারা কিভাবে দিবে? আল্লাহর কালামকে মর্যাদা দেয়ার পরিবর্তে তারা তো সব সময় নিজেদের নফসের খায়েসকেই বেশি প্রাধান্য দেয় আর আল্লাহর কালামকে করে নিজেদের খেয়াল-খুশির অধীন। পৃথিবীতে এ ধরণের লোকদের জন্য কোন ইজ্জত ও সম্মান নেই। এদের সম্পর্কে আল কোরআনে করা হয়েছে কঠোর হুশিয়ারী :

‘তুমি কি কখনও সেই লোকদের অবস্থা চিন্তা করেছো, যে নিজের মনের বাসনা-লালসাকে আপন প্রভু বানিয়ে নিয়েছে? এ ধরণের লোকদেরকে তুমি সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিতে পারো কী? তুমি কি মনে কর তাদের অধিকাংশই শুনতে পায় ও বুঝতে পারে? আসলে এরা তো জন্তু-জানোয়ারের মত, বরং তার চেয়েও অধিকতর পথভ্রষ্ট।’ -[আল-ফুরকান : ৪৩-৪৪]

“তার চেয়ে বড় পথভ্রষ্ট আর কে আছে যে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত হেদায়াতের পরিবর্তে আপন প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো।”- [আল-কাছাছ : ৫০]

আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভে আল কোরআন

মহাগ্রন্থ আল কোরআনে নবী-রাসূলদের দায়িত্ব সম্পর্কে যেসব বর্ণনা পাওয়া যায় তার মধ্যে তাযকিয়াহ বা লোকদের জীবনকে পরিশুদ্ধির কাজ ছিল অন্যতম। আর এই আত্মশুদ্ধির কাজে মূল চালিকা শক্তি ছিল আল্লাহ'র কালাম আল কোরআন। আমাদের সমাজের কিছু লোককে দেখা যায় যারা হেদায়াত লাভের জন্য, আল্লাহ'র নৈকট্য লাভের জন্য আল্লাহ'র কালাম আল কোরআনের কাছে পথের সন্ধান না করে এদিক সেদিক যায়; অথচ তাদের হাতের কাছেই রয়েছে মহাগ্রন্থ আল কোরআন, আল্লাহ'র নৈকট্য লাভের আসল উৎস আল কোরআন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন নিজে বলেন: যারা জ্ঞানবান মানুষ, তারা তোমার প্রতি তোমার প্রভূর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এই গ্রন্থের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে যে, এই গ্রন্থই হচ্ছে সত্য, এটিই মানুষকে পরম পরাক্রান্ত ও প্রশংসিত প্রভূর দিকে নিয়ে যায়।’ -[সূরা আল সাবা: আয়াত-৬]

পবিত্র কোরআন মজিদের শুরুতে সূরা আল ফাতিহায় আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন নিজে আমাদেরকে দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন যেন আমরা কেবল তাঁর কাছেই সঠিক পথের সন্ধান (সিরাতুল মুশতাক্বিম) জানতে চাই।

আমরা আগেই বলেছি, পৃথিবীতে নবী-রাসূলদের অন্যতম প্রধান মিশন ছিল মানুষের জীবনকে পরিশুদ্ধ করা। পবিত্র কোরআনে যতবার এই আত্মশুদ্ধির প্রসঙ্গটি আলোচনা করা হয়েছে ততবারই অনিবার্যভাবে আলকোরআনের কথা  বলা হয়েছে। যেমন : ‘যেমন আমি তোমাদের প্রতি তোমাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল পাঠিয়েছি, যে তোমাদেরকে আমার আয়াত পড়ে শোনায়, তোমাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ ও উৎকর্ষিত করে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয় এবং যেসব কথা তোমাদের অজ্ঞাত তা তোমাদের জানিয়ে দেয়।’ -[বাকারা : ১৫১]

‘তিনি সেই সত্তা যিনি নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদেরকে তাঁর আয়াতসমূহ পড়ে শোনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন। অথচ এর আগে তারা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।’ -[জুমুয়া : ২]

‘প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার লোকদের প্রতি আল্লাহ এ বিরাট অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদেরই মধ্য হতে এমন একজন নবী বানিয়েছেন যে তাদেরকে আল্লাহ'র আয়াত শোনান, তাদের জীবনকে ঢেলে তৈরি করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেন। অথচ এর পূর্বে এসব লোকই সুস্পষ্ট গোমরাহির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।-[আল ইমরান : ১৬৪]

আত্মশুদ্ধির বাস্তব দৃষ্টান্ত

মহানবীর বিপ¬বী জীবনাদর্শের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যে চরম পাপাচারে নিমজ্জিত একটি অধঃপতিত, বর্বর ও অসভ্য জনগোষ্ঠীকে এমনভাবে পরিশুদ্ধ করলেন যে, তারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হলেন এবং মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার উৎকর্ষে এতটা সফল হলেন যে, সমগ্র মানব জাতির সামনেই তারা চিরকালের আদর্শ হয়ে থাকলেন। জগৎবাসীর সামনে তারা মানবীয় মাহাত্মের মূর্ত প্রতীক এবং সত্যের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে থাকলেন। মানবতার আদর্শ ও পথ-প্রদর্শক হয়ে তারা পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিলেন এবং পথহারা মানুষকে পথের দিশা দিয়ে মানবতার সম্মান ও গৌরবকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তাঁদের এই কৃতিত্বের কথা, তাঁদের এই নেতৃত্ব, মাহাত্ম ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্বয়ং আল কোরআনে এভাবে ঘোষিত হয়েছে -‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবতার কল্যাণের জন্যই তোমাদের আবির্ভাব। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহ'র উপর প্রবল প্রত্যয় নিয়ে চল।’ -[আলে ইমরান : ১১০]

আল কোরআন: সৌভাগ্যের পরশ পাথর

প্রশ্ন হল কোন যাদুর কাঠির স্পর্শে একজন নিরক্ষর মানুষ একটি দুধর্ষ, বর্বর, রক্তপিপাষু জাতিকে, একটি চরম পশু সমাজকে - যেখানে দারিদ্র ও বলাৎকারের ভয়ে পিতা তার আপন কন্যাকে আতুড় ঘরেই মেরে ফেলতো কিংবা জীবন্ত মাটিচাপা দিত; যেখানে নারী ছিল শুধুই ভোগের পণ্য, যেখানে যেনা-ব্যভিচার-পাপাচার ক্যান্সারের মত পুরো সমাজদেহকে আক্রান্ত করেছিল, অশি¬লতা, নোংরামির যেখানে কোন সীমা ছিল না, ছিল না নারীর ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তার কোন সামান্য নিশ্চয়তা; যার কারণে মেয়ে শিশুর জন্মকে পিতা-মাতা কখনো স্বাগত জানাতো না; মানুষের জান-মাল-ইজ্জতের কোন নিরাপত্তা যে সমাজে ছিল না; তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই যেখানে মাসের পর মাস বছরের পর বছর মারামারি, খুনাখুনিই লেগেই থাকত; চরম স্বার্থপরতা আর ভোগবাদী মানসিকতা যাদেরকে পশুতে পরিণত করেছিল, এমনি শত গোত্রে বিভক্ত ও ছিন্ন-ভিন্ন একটি ‘ব্যর্থ’ সমাজ ও রাষ্ট্রকে তিনি কীভাবে পরিশুদ্ধ করে একটি সুসংহত ও শ্রেষ্ঠজাতিতে পরিণত করলেন? কোন পদ্ধতিতে? কোন শক্তিতে?

বলাবাহুল্য, ঐশীগ্রন্থ আল কোরআনই হলো সেই সৌভাগ্যের পরশ পাথর, যার স্পর্শে একটি গৌরবহীন জাতি গৌরবদীপ্ত হয়, সম্মানহীন জাতি সম্মান লাভ করে। ঐশী পথনির্দেশ বা হেদায়াত হলো সেই চিরন্তন আবে হায়াত, যা মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধির অনন্ত উৎস। আল্লাহ'র নূর বা ঐশী আলোক হলো সেই চিরন্তন রক্ষাকবচ, যা মানুষের ইজ্জত, সম্মান ও নিরাপত্তার পাহারাদার। আরবের সেই বর্বর লোকগুলো আল্লাহ'র কালামকে, তাঁর হেদায়াতকে মাথায় তুলে ধরেছিল, তারা আল¬াহর আয়াতকে সম্মান করেছিল আর এ ব্যাপারে মুহাম্মদ (সঃ) কে রাসূল অর্থাৎ আল্লাহ'র আনুগত্যের ব্যাপারে তাঁকে চরম আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আর আল্লাহ'র কালামের বিশেষত্ব হচ্ছে - পৃথিবীতে আল্লাহ'র কালামকে যারা সম্মান করবে বিনিময়ে আল্লাহও দুনিয়া ও আখেরাতে তাদেরকে সম্মানিত করবেন, গৌরবান্বিত করবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ'র সুস্পষ্ট ঘোষণা :

‘আমার নেক বান্দাগণই পাবে পৃথিবীর উত্তরাধিকার।’ -[আল আম্বিয়া : ১০৫]

প্রথম মানব-মানবী বাবা আদম আর মা হাওয়াকে পৃথিবীতে পাঠানোর সময়ও আল্লাহ এ ঘোষণা দিয়েছিলেন :

‘তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। এরপর আমার পক্ষ থেকে যে জীবনবিধান তোমাদের কাছে পাঠানো হবে - যারা আমার সে হেদায়াতকে মেনে চলবে তাদের জন্য ভয়-ভীতি ও চিন্তার কোন কারণ থাকবে না। আর যারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে এবং আমার বাণী ও আদেশ নিষেধকে মিথ্যা গণ্য করবে, তারা নিশ্চয়ই জাহান্নামী হবে এবং সেখানে তারা চিরদিন থাকবে।’-[বাকারা : ৩৮-৩৯]

হেদায়াত হলো আল্লাহ'র নূর। এ নূরের অভাবেই পৃথিবীতে ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। তখন নানাবিধ সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে মানব সমাজ। আর এ কারণেই আল্লাহ'র  নবী-রাসূলগণ কোন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন না করে আল্লাহ'র এ নূরকেই মানুষের চিত্তে প্রজ্জ্বলিত করে সমাজ-মানসকে পরিশুদ্ধ ও নিস্কলুস করার করার চেষ্টা করেছেন। মানুষের বিবেক ও মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করার মাধ্যমে একটি সামগ্রীক বা পূর্ণাঙ্গ সমাজ-বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

চিন্তার পুনর্গঠন ও আত্মশুদ্ধিই সমাজ পরিবর্তনের প্রথম সোপান

আসলে মানুষের ঈমান বা তাদের বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার পরিশুদ্ধিই হলো আত্মশুদ্ধি বা সমাজ-সংস্কারের প্রথম সোপান। আর এ চিন্তার বিশুদ্ধি বা ঈমানের অনিবার্য দাবীই হচ্ছে তা মানুষের কর্মধারাকে আখেরাতমুখী করে দেবে, আল্লাহ'র হুকুম পালনে, স্রষ্টার সামনে নিজেকে সোপর্দ করে দিতে, তাঁর কাছে আত্মসমর্পন করতে উদ্বুদ্ধ করবে। তখন নফসের গোলামী, লোভ, হিংসা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, জিঘাংসা মানুষের কাছে খুবই জঘন্য, হীন ও ইতরতা বলে মনে হবে। নফসের তাড়নায় কখনো কোন ভুল করে ফেললেও এ ঈমানই আবার তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবে এবং নফসের গোলামী ও পাপের জন্য সে অনুতপ্ত হবে এবং এজন্য বার বার সে প্রভুর কাছে লজ্জিত হবে, ক্ষমা ভিক্ষা করবে। এ প্রসঙ্গে মহানবী বলেছেন -‘ঈমানদার ব্যক্তি ও ঈমানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে খুঁটির সাথে (দড়িবাঁধা) ঘোড়া, সে চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত খুঁটির দিকেই ফিরে আসে। অনুরূপভাবে ঈমানদার ব্যক্তিও ভুল করে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ঈমানের দিকেই ফিরে আসে। অতএব তোমরা মুত্তাকী লোকদেরকে তোমাদের খাদ্য খাওয়াও এবং ঈমানদার লোকদের সাথে ভাল ব্যবহার কর।’ [বায়হাকী]

কাজেই ঈমানদারী আর নফসের গোলামী এ দুটো কখনো একসাথে চলতে পারে না। বরং আমলের পরিশুদ্ধিই হলো  ঈমানদারীর বৈশিষ্ট। মহানবী (সঃ) বলেছেন - ‘ছবর (ধৈর্য ও সহনশীলতা) আর ছামাহাত (দানশীলতা, নমনীয়তা ও উদারতা) হচ্ছে ঈমান।’ -[মুসলিম] 

নফসের সংকীর্ণতার কারণে দেখা যায় যে, মানুষ নিজের জন্য তো সব সময় ভাল জিনিসটি পছন্দ করে, কিন্তু অপরের বেলায় তা ভুলে যায়; নিজে ভাল জিনিসটি গ্রহণ করে অপরকে খারাপটি প্রদান করে। যেমন অনেক সময় দেখা যায় যে, আমরা পঁচা ও পুরাতন টাকা বেছে বেছে অন্যকে দেই, আর ভাল ও নতুন টাকা নিজের কাছে রেখে দিই। কিন্তু ইসলামী সংস্কৃতি কিন্তু এর বিপরীত। এ প্রসঙ্গে মহানবীর (সঃ) বাণী হচ্ছে - ‘তোমাদের মধ্যে কেউই ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, তার ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ না করবে।’ [বুখারী-মুসলিম] 

এ ঈমানদারীর বৈশিষ্ট সম্পর্কে মহানবী (সঃ) আরো বলেছেন - ‘তোমাদের মধ্যে কেউই ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ তার কামনা-বাসনাকে আমার উপস্থাপিত দ্বীনের অধীন না করবে।’ -[শরহু সুন্নাহ]

একবার এক সাহাবী মহানবীকে জিজ্ঞেস করলেন যে, ঈমান কাকে বলে, তার নিদর্শন বা পরিচয় কি? তখন মহানবী যা উত্তর করলেন তা হলো- ‘তোমাদের ভাল কাজ যখন তোমাদেরকে আনন্দ দিবে এবং অন্যায় ও খারাপ কাজ যখন তোমাদেরকে অনুতপ্ত করবে তখন তুমি বুঝবে যে, তুমি মুমিন ব্যক্তি।’ -[মুসনাদে আহমদ]

কাজেই বাস্তব কর্মক্ষেত্রের কঠিন ময়দানে আল্লাহ'র আনুগত্যই হচ্ছে ঈমানের অনিবার্য দাবী। ইসলামের পরিভাষায় একেই আমলে সালেহ বা নেক আমল বলা হয়। বাস্তব আনুগত্যের ক্ষেত্রে এসে মানুষের ঈমান ও বিবেক যে অগ্নি-পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, সে পরীক্ষার আগুনে পুড়ে পুড়ে মানুষের সত্তার যে বিনির্মাণ হয় তাতেই হয় তার যথার্থ তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি। আর ইসলামের দৃষ্টিতে এটিই হচ্ছে মনুষ্যত্বের যথার্থ বিকাশ-প্রক্রিয়া। কিন্তু এই বাস্তব কর্ম ও পরীক্ষা ক্ষেত্রকে শয়তানের হাতে ছেড়ে দিয়ে যদি কেউ শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক উপাসনা আর বাহ্যিক বেশভুষাকেই আত্মশুদ্ধির একমাত্র উপায় মনে করে তাহলে সে ব্যক্তি সমাজে একজন দ্বীনদার পরহেজগার হিসেবে পরিচিতি পেয়ে হয়তো আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারে, কিন্তু তার এ আত্মতৃপ্তি পরকালে খুব একটি কাজে আসবে না।
কোরআন অধ্যয়ন ও প্রচারের গুরুত্বপৃথিবিতে আল্লাহ’র কালাম এবং সেই সাথে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র জীবনের প্রধান মিশন ছিল মানুষের জীবনকে পরিশুদ্ধ করা, তাদেরকে নৈতিক মানে সমুন্নত করা। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন মহানবীর এই মিশন সম্পর্কে বলেছেন:

‘তিনিই উম্মিদের মধ্য থেকে একজনকে রাসূল রূপে প্রেরণ করেছেন; যে তাদেরকে তাঁর আয়াত আবৃত্তি করে শোনায়, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও কৌশল শিক্ষা দেয়। ইতিপূর্বে তো এরা ঘোর বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।’-[জুমু’আ : ২]

‘তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তাদের কাছে একজন রাসূল পাঠিয়ে আল্লাহ মোমেনদের প্রতি অবশ্য অণূগ্রহ করেছেন। সে তাঁর (আল্লাহ’র) আয়াত তাদের নিকট আবৃত্তি করে শোনায়, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়। এর পূর্বে তো তারা সুস্পষ্ট গোমরাহির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।’-[আলে ইমরান : ১৬৪]

কোরআন অধ্যয়ন ও প্রচারের গুরুত্ব

মহাগ্রন্থ আল কোরআন হচ্ছে আল্লাহ’র  দেয়া সবচেয়ে বড় নেয়ামত। এটি অত্যন্ত বরকতময় গ্রন্থ যা আমাদের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। তাই পবিত্র এই রমজান মাসে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত, অধ্যয়ন এবং উপলব্ধি করা বড় প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল¬াহ রাব্বুল আ’লামীন বলেন:

‘এ কিতাব আমি অবতীর্ণ করেছি, এটি বরকতপূর্ণ। এতএব তোমরা এর অনুসরণ কর এবং নিষিদ্ধ সীমা পরিহার করে চল। তবেই তোমরা রহমত প্রাপ্ত হবে।’-[আল আনআম : ১৫৫]

‘(হে নবী!) এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যেন বুদ্ধিমান লোকেরা একে গভীর ভাবে অধ্যয়ন ও চিন্তা-ভাবনা করে।’ -[আস সোয়াদ : ২৯]

আল্লাহ’র কালাম আল কোরআন দ্বীনের মূল উৎস। যারা কোরআন পড়ে না, কোরআন থেকে হেদায়াত তালাশ করে না তারা দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও বুঝ থেকে বঞ্চিত। যারা আল্লাহ’র  দেয়া হেদায়াত গ্রন্থ আল কোরআনকে বাদ দিয়ে বিকল্প পথে দ্বীন তালাশ করে তারা মূলত আন্দাজ ও অনুমান নির্ভর মতবাদে বিশ্বাসী এবং মিথ্যা আকাক্সক্ষাই হল তাদের একমাত্র ভরসা। আল কোরআনের ভাষায় তারা নিরেট মূর্খ ছাড়া আর কিছুই নয়:

‘তোমাদের কিছু লোক নিরক্ষর। তারা মিথ্যা আকাক্সক্ষা ছাড়া আল্লাহ’র কিতাবের কিছুই জানে না। তাদের কাছে কল্পনা ছাড়া কিছু নেই।’ -[আল বাকারা : ৭৮]

‘আমি তোমার প্রতি আমার জিকির (আল কোরআন) অবতীর্ণ করেছি, যাতে লোকদের সামনে ঐসব বিষয় বর্ণনা করতে পারো, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে। যেন তারা চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।’

আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এরও প্রথম ও প্রধান কাজ ছিল আল্লাহ’র  কালাম আল কোরআনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং কোরআনের শিক্ষার দিকে মানুষকে আহবান জানানো। মূলত আল্লাহ’র  দিকে আহবান করা বলতে কিন্তু আল্লাহ’র  কালামের দিকে, আল্লাহ’র হুকুম-আহকাম ও তাঁর হেদায়াতের দিকে মানুষকে আহবান করাকেই বুঝায়। তাই মহানবীর জীবনের অন্যতম প্রধান মিশন ছিল আল কোরআনের প্রচার করা, আল¬াহর কালামকে যথাযথভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ  বলেছেন :

‘হে রাসূল! তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা যথাযথভাবে প্রচার কর। যদি তা না কর, তাহলে তো তুমি আল্লাহ’র রিসালাতকে  পৌঁছালে না।’ -[আল মায়েদা : ৬৭]

‘হে চাদর আবৃত্ত শয্যাগ্রহণকারী, ওঠো, সাবধান কর, আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। -[মুদ্দাস্সির : ১-৩]

 আর এ কোরআন আমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যেন এর দ্বারা তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে এটি পৌঁছবে তাদের সবাইকে সাবধান করে দিতে পারি।’-[আনআ’ম : ১৯]

‘প্রচার করাই রাসূলের কর্তব্য। তোমরা যা প্রকাশ কর এবং গোপন কর সে সম্পর্কে আল্লাহ জানেন।’-[আল মায়েদা : ৯৯]

‘কত মহান তিনি যিনি তাঁর বান্দার উপর ফোরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) নাযিল করেছেন, যাতে সে বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হতে পারে।’-[ ফোরকান : ১]

এমনিভাবে পবিত্র কোরআন মজিদের আরো অসংখ্য আয়াত উদ্ধৃত করা যায়, যাতে উলে¬খ করা হয়েছে যে, কোরআন প্রচার করা, মানুষের কাছে আল্লাহ’র কালাম পৌঁছে দেয়া, তাদেরকে কোরআন মজিদ তেলাওয়াত করে শোনানো, এর বিষয়বস্তু ও শিক্ষা তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া, এর আলোকে মানুষকে কর্ম-কৌশল ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করে তোলা, কোরআনের শিক্ষার আলোকে মানুষের মধ্যে বিরাজমান অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও গোমরাহি দূর করা এবং তাদেরকে সতর্ক ও সচেতন করে তোলা ছিল আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) নবুয়তী দায়িত্ব।

ঈমানদারদের উদ্দেশ্যে দায়ী ইলাল্লাহ'র কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার উৎসাহ দিয়ে আল্লাহ বলেছেন :

‘তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে যে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান করে, সৎ কাজ করে আর ঘোষণা করে যে আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।’-[হা-মীম-আস্সাজদা : ৩৩]

আল্লাহর নবী এবং সাহাবায়ে কেরাম তাই নিজেদের জীবনে কোরআন প্রচারের এ কাজকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়েছিলেন। কারণ আল্লাহর কালাম আল কোরআন হল আল্লাহর নৈকট্য ও হেদায়াতের সেই ফল্গুধারা, সেই সিরাতুল মুস্তাক্বিম; সূরা ফাতিহার মুনাজাতের মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়তই যার প্রার্থনা করে থাকি। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের প্রতি রাকায়াতেই আমরা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে থাকি -‘আমাদেরকে সহজ-সঠিক পথে পরিচালিত কর। সে সব লোকের পথ যাদেরকে তুমি পুরুষ্কৃত করেছো; তাদের পথ নয়, যারা পথভ্রষ্ট ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।

বস্তুত, আল ফাতিহার প্রার্থনার জবাবই হচ্ছে সমগ্র আল কোরআন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই আমাদেরকে এ প্রার্থনা শিখিয়ে দিয়েছেন এবং আবার তিনিই আমাদেরকে আমাদের প্রার্থীত সিরাতুল মুস্তাক্বিম পথের দিশা দিয়ে ধন্য করেছেন। আবার আল কোরআনের এই ঐশী হেদায়াত মূলত সেই শাশ্বত পথ; যে পথের সুসংবাদ আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানোর সময় দিয়েছিলেন। আদিপিতা হযরত আদম (আঃ)-কে বেহেশত থেকে পৃথিবীতে পাঠানোর সময় আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছিলেন, যুগে যুগে তাঁর পক্ষ থেকে নবী-রাসূলদের মাধ্যমে মানুষের কাছে ঐশী পথ-নির্দেশ বা জীবন বিধান পাঠানো হবে। যারা সেই হেদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের জন্য ভয় ও বিপদের কোন কারণ থাকবে না। কিন্তু যারা আল্লাহর দেয়া সেই জীবন-বিধানের বিরোধিতা করবে, তারাই হবে বিভ্রান্ত ও ব্যর্থ। তাদের জন্য রয়েছে বিপর্যয় ধ্বংস। পবিত্র কালামে মজিদে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ প্রসঙ্গটি উল্লােখ করেছেন এভাবে :

‘তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। এরপর আমার পক্ষ থেকে যে জীবন-বিধান তোমাদের নিকট পৌঁছানো হবে; যারা সে বিধান মেনে চলবে তাদের জন্য কোন ভয় ও চিন্তার কোন কারণ থাকবে না। আর যারা সে বিধান গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে এবং আমার বাণী ও আদেশ-নিষেধকে মিথ্যা গণ্য করবে, তারা নিশ্চয় জাহান্নামী হবে এবং তারা সেখানে চিবদিন থাকবে।’ -[আল বাকারা : ৩৮-৩৯]

সুতরাং আল্লাহর কালাম আল কোরআনই হল মুক্তির একমাত্র পথ। আল্লাহর দেয়া হেদায়াতই তাঁর নৈকট্য বা খোদাপ্রাপ্তির যথার্থ সিরাতুল মুস্তাক্বিম। আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ বা ওসিলা তালাশ করতে হলে আমাদেরকে তাই কোরআনের পথের দিকেই ফিরে আসতে হবে। কারণ এ পথই ঈমানের পথ, এ পথই হেদায়াতের পথ। এ পথই নির্ভেজাল জ্ঞান ও সত্যের পথ। কোন বুযুর্গ ও কোন বাবার পাও ধরা এ পথের বিকল্প হতে পারে না। আল্লাহ কথার চেয়ে কোন মানুষের কথাকে বড় মনে করলে কেবল শয়তানের সান্নিধ্যই লাভ হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর নৈকট্য ও হেদায়াত তাতে কখনো লাভ হতে পারে না। যারা মনে করে আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পন না করে কোন পীর-মাশায়েখ বা তথাকথিত বুযুর্গ ব্যক্তিদের পা ধরে পরে থাকলেই নাযাত পাওয়া যাবে তারা মূলত ঐসব ব্যক্তিদেরকেই খোদার আসনে বসিয়ে দেয়। কারণ কোন মানুষ কখনো অপর মানুষের প্রভু হুকুমকর্তা হতে পারে না, নিরংকুশ আনুগত্য বা গোলামী দাবী করতে পারে না। যারা এসব করে তারা পরিষ্কার শিরক ও পৌত্তলিকতার মধ্যে নিমজ্জিত। কারণ এসব কর্মকাণ্ড তাওহীদের শাশ্বত আদর্শ ও ঈমানী চেতনার পরিপন্থী। যারা এসব কাজে লিপ্ত তারা পরিষ্কার বিভ্রান্তি ও ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত।

সূরা আসরে পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছে যে, দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা বা কামিয়াবী নির্ভর করছে চারটি জিনিসের উপর। ১. ঈমান, ২. আল্লাহর হুকুম পালন বা নেক আমল, ৩. হকের দাওয়াত বা ইসলামের প্রচার এবং ৪. সবর বা ধৈর্য ও সহনশীলতার নীতি। বলা হয়েছে সত্যের এ চারটি মূলনীতি থেকে যারা বিচ্যূত হয়েছে তারাই ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। অতীতে যারা এ পথ থেকে বিচ্যূত হয়েছিল তারা যেমন ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল; বর্তমানেও যারা ঈমানদারী, আল্লাহ হুকুম পালন এবং সহনশীলতার নীতি হকের দাওয়াতের পথ থেকে বিচ্যূত হয়েছে তারাও সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি ও ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত এবং ভবিষ্যতেও যা এ পথ থেকে বিচ্যূত হবে ও তারাও ক্ষতির মধ্যেই নিমজ্জিত থাকবে। আর এ ক্ষতি হল দুনিয়া ও আখেরাতেরই চরম ক্ষতি।

বস্তুত, পৃথিবীতে আল্লাহর কালামই হচ্ছে পরম সত্য ও নিরংকুশ জ্ঞানের উৎস। কোন ধরনের বিভ্রান্তি, ভুল চিন্তা, ভুল মত, কোন ধরনের অসম্পূর্ণতা ও অসঙ্গতি এতে নেই। সামান্য সন্দেহ-সংশয় বা অনুমান নির্ভর কোন কথাও এতে বলা হয়নি। মিথ্যা ও বিভ্রান্তি থেকে আল্লাহর কালাম সর্বতো ভাবে মুক্ত ও পবিত্র। এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে আল্লাহ চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন :

‘যারা জ্ঞানবান মানুষ, তারা তোমার প্রতি তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এ গ্রন্থ সম্পর্কে মনে করে যে, এ গ্রন্থই হচ্ছে সত্য, এটি মানুষকে পরাক্রান্ত ও প্রশংসিত প্রভুর দিকেই নিয়ে যায়।’ -[সাবা : ৬]

বস্তুত, আল কোরআনের সাথে কোন মানুষের কথা বা বয়ান তুলনীয় হতে পারে না। কারণ আল্লাহ  তায়ালাই বলে দিচ্ছেন এভাবে :

‘হে মুহাম্মাদ! বলে দাও, যিনি আসমান ও জমিনের সকল রহস্য জানেন এ কিতাব তিনিই নাযিল করেছেন। তিনি ক্ষমাশীল, মেহেরবান।’ -[ফুরকান : ৬]

‘নিশ্চিতরূপে এ এক সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত কিতাব। মিথ্যা না এর সামনে থেকে আসতে পারে আর না পেছন থেকে। এ এক প্রাজ্ঞ ও প্রশংসিত সত্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। -[হা-মীম-আস সিজদাহ : ৪১]

‘এ কিতাবে কোন কথাই সন্দেহের ভিত্তিতে বলা হয়নি।’ -[বাকারা : ২]

বস্তুত, কোন মানুষের বা তথাকথিত কোন পীর বা বুযুর্গ ব্যক্তির কোন কথা বা মতবাদ এ মর্যাদা পেতে পারে না। সকল ধরনের পবিত্রতা ও প্রশংসা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত। কারণ কেবলমাত্র তিনিই এর যোগ্য, অন্য কেউ নয়। এটিই আল কোরআনে বর্ণিত তাওহীদ বা একত্ববাদের মূলকথা। ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা সর্বাবস্থায় ঈমানের এ চেতনাকে লালন করেন এবং এ থেকে তারা কখনো বিচ্যূত হন না।

আল্লাহর কালাম থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য কিছু বিভ্রান্ত অথচ লেবাসধারী লোক আল কোরআন সম্পর্কে মানুষকে অহেতুক আতংকিত করে তুলছে। তারা একে অত্যন্ত জটিল অস্পৃশ্য গ্রন্থ বলে বর্ণনা করে এ গ্রন্থোর অর্থ জানা থেকে লোকদেরকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। যেমনটি করতো কুরাইশ মুশরিকেরা। তারা কোরআন সম্পর্কে নানা অপপ্রচার করে বেড়াতো যাতে লোকেরা কোরআন না শোনে। কারণ কোরআন শুনলেই লোকেরা কোরআনের কথায় আকৃষ্ট হতো। এক সময় খ্রিস্টান পাদ্রী-পুরোহিত ধর্মগ্রন্থ পাঠ থেকে লোকদেরকে বিরত রাখতো। হিন্দু-ব্রাহ্মণগণও এ কাজটি করতো। তারা বাংলা ভাষায় ধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদকে নিষিদ্ধ করেছিলো। যারা মাতৃভাষায় ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করার চেষ্টা করতো তাদেরকে রৌরব নরকের ভয় দেখানো হত। এ সবেরই উদ্দেশ্য ছিল ঐশী আদর্শের পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া মতকে প্রাধান্য দেয়া। আল্লাহর কথার চেয়ে নিজেদের কথাকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই কোরআনের কথাকে অত্যন্ত কঠিন, জটিল ও বোধগম্যহীন বলে বর্ণনা করে এর অর্থ জানা থেকে লোকদেরকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ আল কোরআন হচ্ছে বিশ্বের সকল মানুষের জন্যই আল্লাহ প্রদত্ত এক সুস্পষ্ট হেদায়াত বা পথ-নির্দেশ। আল্লাহ বলেন :

‘নিঃসন্দেহে এ কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা একেবারেই সহজ-সরল।’-[বনি ইসরাইল : ৯]

এসব বৈরী প্রচারণা এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি নিস্পৃহতার কারণে আমাদের সমাজে কোরআনের শিক্ষা জানার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখা যায় না, কোরআন পড়া হয় শুধু তেলাওয়াতের উদ্দেশ্যে। অথচ যে কোন গ্রন্থ পড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে জানা। আমরা যদি কোন গ্রন্থের শিক্ষাকে নিজেদের জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তাহলে সে গ্রন্থের শিক্ষা জানার জন্যই আমরা তা পড়ে থাকি। গ্রন্থটি যদি এমন ভাষায় লিখিত হয়, যা আমরা জানি না, তাহলে আমরা গ্রন্থটির শিক্ষাকে অত্যন্ত জরুরী মনে করার কারণেই তার অনুবাদ জানার চেষ্টা করি। কারণ অর্থ না জানলে গ্রন্থাকার কী বলতে চান তা আমরা কীভাবে বুঝব? আর  কোন একটি বই পড়ে তা থেকে কোন কিছু জানতে ও বুঝতে যদি আমরা নাই পারি তাহলে সে গ্রন্থ পড়াকে আমরা অর্থহীন বলে থাকি। কোন সুস্থ ব্যক্তিই নিশ্চয়ই এমন আচরণ করেন না। অর্থাৎ কেউ যদি নিয়মিতভাবে এমন একটি বই পড়ে যে বইটির ভাষা সে জানে না, গ্রন্থটি সে খুবই শুদ্ধ করে পড়তে পারে কিন্তু তার অর্থ কিছুই জানে না এবং জানার চেষ্টাও করে না অথচ সেই ব্যক্তি দাবী করে যে সে ঐ গ্রন্থের লেখককে খুবই ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে আর একই ভাবে তার গ্রন্থটিকেও সে তার জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে; তাহলে ঐ ব্যক্তির এহেন আচরণে আমরা নিশ্চয়ই সন্দিহান হয়ে পড়ব যে, সে আসলে সুস্থ আছে কিনা! অথবা তার এ সব আচরণকে আমরা পাগলামি ও হাস্যকর যে মনে করব তাতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। আর এই উদ্ভট ও হাস্যকর আচরণের মাধ্যমে ঐ গ্রন্থ ও গ্রন্থ-প্রণেতার প্রতি পাঠকের শ্রদ্ধা, ভালোবাসার দাবীও যে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তাও নিশ্চয়ই আমরা চিন্তা করে দেখতে চাইব।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সাথে আমরা প্রতিনিয়ত উদ্ভট ও হাস্যকর আচরণ করে যাচ্ছি। আরবদের কাছে আল কোরআন তো কোন দুর্বোদ্ধ গ্রন্থ ছিল না। তারা তো কোরআন তেলাওয়াত করে এর অর্থ সহজেই বুঝতে পারতেন। যার কারণে আল্লাহর রাসূল তাদেরকে বেশি বেশি করে কোরআন তেলাওয়াতের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং এর জন্য অশেষ সওয়াব প্রাপ্তির কথা বলেছেন। কারণ, বেশি বেশি করে কোরআন তেলাওয়াত করার কারণে কোরআনের শিক্ষা তাদের হৃদয়পটে গাঁথা হয়ে যেত। আর ইসলামী জিন্দেগী যাপনের জন্য এর অপরিহার্য প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু আমরা যারা আরবি ভাষা জানি না তারা যদি কোরআনের অর্থ জানার চেষ্টা না করে শুধু তেলাওয়াত করি তাহলে আমাদের কোরআন পড়ার হক কতটুকু আদায় হবে তা কি ভেবে দেখা উচিত নয়? আল্লাহ আমাদেরকে কোরআন পড়ার যে নির্দেশ দিয়েছেন তা কি কোরআনের শিক্ষাকে জানা ও বুঝার জন্য নয়? আমরা যদি কোরআনের শিক্ষাকে না জানি তাহলে কোরআন থেকে হেদায়াত নেয়া আমাদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হবে?

পবিত্র কোরআনের শিক্ষাকে জানা ও বুঝার কারণে দ্বীনের যে ধরনের বুঝ, যে ধরনের ঈমান ও উপলব্ধি তৈরি হওয়া সম্ভব তা কি অর্থ না জেনে তেলাওয়াতের মাধ্যমে, আল্লাহর বড়ত্ব ও মাহাত্ম সম্পর্কে বেখবর থাকার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব? মোটেই সম্ভব নয়। কারণ স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনই এ প্রসঙ্গে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, জ্ঞানী আর মূর্খের উপলব্ধি সমান নয়। আর জ্ঞানীরাই আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে, তারাই হেদায়াত থেকে বেশি উপকৃত হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন :

‘এটা কি করে সম্ভব হতে পারে যে, যে ব্যক্তি তোমার আল্লাহর এই কিতাবকে, যা তিনি তোমার প্রতি নাযিল করেছেন, সত্য বলে জানে আর যে ব্যক্তি এ মহাসত্য সম্পর্কে অজ্ঞ-অন্ধ তারা দুজনই সমান হতে পারে? উপদেশ তো বুদ্ধিমান লোকেরাই কবুল করে থাকে।’ -[রা’দ : ২০]

সুবহানাল্লাহ! কী দুর্ভাগ্য আমাদের! আল কোরআনের এমন সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও আজ আমরা উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করেছি! আল্লাহর কথার চেয়ে আজ আমরা তথাকথিত মুরুব্বিদের কথাকেই যেন বেশি প্রাধান্য দিয়ে চলেছি। আল্লাহ বলছেন জানো, জানতে চেষ্টা কর! আর মুরুব্বি/বুযুর্গ রূপী আযাযিল ওয়াসওয়াসা দিয়ে বলছে খবরদার, কোরআনের অর্থ জানার চেষ্টা ক’রো না, শুধু তেলাওয়াত কর, শুধু তেলাওয়াত...!

শুধুই তেলাওয়াত? আর কিছুর প্রয়োজন নেই? কোরআন কেন পাঠানো হয়েছে তা জানারও কোন প্রয়োজন নেই? চিন্তা-ভাবনারও প্রয়োজন নেই? মহাগ্রন্থ আল কোরআন এসেছে কি শুধু না বুঝে তেলাওয়াতের জন্য? কিন্তু কোরআন যিনি পাঠিয়েছেন সেই পরওয়ার দিগার এ সম্পর্কে কী বলছেন :

‘এ কিতাব আমি অবতীর্ণ করেছি, এটি বরকতপূর্ণ। এতএব তোমরা এর অনুসরণ কর এবং নিষিদ্ধ সীমা পরিহার করে চল। তবেই তোমরা রহমত প্রাপ্ত হবে।’-[আল আনআম : ১৫৫]

‘(হে নবী!) এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যেন বুদ্ধিমান লোকেরা একে গভীর ভাবে অধ্যয়ন ও চিন্তা-ভাবনা করে।’ -[আস সোয়াদ : ২৯]

‘তোমাদের কিছু লোক নিরক্ষর। তারা মিথ্যা আকাক্সক্ষা ছাড়া আল্লাহর কিতাবের কিছুই জানে না। তাদের কাছে কল্পনা ছাড়া কিছু নেই।’ -[আল বাকারা : ৭৮]

‘আমি তোমার প্রতি আমার জিকির (আল কোরআন) অবতীর্ণ করেছি, যাতে লোকদের সামনে ঐসব বিষয় বর্ণনা করতে পারো, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে। যেন তারা চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।’

আল্লাহ আমাদের মাফ করুন। আমরা প্রতিদিন, প্রতি ওয়াক্তে অত্যন্ত তাযিমের সাথে কোরআন তেলাওয়াত করি কিন্তু ভুলে একবারও আমাদের জানতে ইচ্ছে করে না এই পবিত্র বাণী গুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আ'লামিন কী বলেছেন। আর ঠিক এ কারণেই নিরক্ষর লোকদের মতই আমরা আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে আন্দাজ-অনুমান, ধারণা-কল্পনা নির্ভর আকিদা-বিশ্বাস লালন করছি আর মিথ্যা আকাক্সক্ষার আশ্রয় নিয়ে অজ্ঞতা ও মূর্খতার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি। মানসিক এই বৈকল্যের কারণেই আজ আমাদের চিন্তা-চেতনাও হয়ে গেছে পঙ্গু ও নি¯প্রাণ। এ কারণেই আমাদের ঈমান আজ চেতনাহীন। আল্লাহর কালাম আল কোরআনের মর্যাদা আজ ভুলুণ্ঠিত।কেননা, বিশ্ব জাহানের মালিক আল্লাহর হুকুম আজ সর্বোচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ও বিজয়ী বেশে নেই। আল্লাহর হুকুম আজ মানুষের হুকুমের অধীন! আল্লাহর আইন আজ মানুষের আইনের অধীন! কোরআন এসেছে শাসন করার জন্য, শাসিত হওয়ার জন্য নয়। অথচ এ সম্পর্কে আজ আমাদের কোন চেতনাই নেই। আমাদের অন্তর আজ এতটাই মরে গেছে যে, এই কঠিন অন্তরের মধ্যে বোমা মারলেও যেন আর সম্বিত ফিরে আসবে না। অথচ আল্লাহ বলেছেন:

‘আমি যদি এই কোরআনকে কোন পাহাড়ের উপরও নাযিল করতাম, তাহলেও তুমি দেখতে যে, সে পাহাড় আল্লাহর ভয়ে কেমন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে! এই দৃষ্টান্ত গুলো আমি এ জন্য দেই, যেন লোকেরা নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে।’-[আল হাশর : ২১]

আমাদের অন্তর ইহুদীদের মত এত কঠিন ও অভিশপ্ত হয়ে উঠল কীভাবে? আল্লাহ বলছেন এই পবিত্র কালামকে যদি তিনি মানুষের উপর নাযিল না করে কোন নিষ্প্রাণ পাহাড়ের উপরও নাযিল করতেন, তাহলে এই মহা নেয়ামতপূর্ণ কোরআনের ব্যাপারে দায়িত্বানুভূতি ও জবাবদিহিতার ভয়ে নিষ্প্রাণ পাহাড়ও কেঁদে উঠতো, আল্লাহর ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গলে গলে পড়তো। অথচ আকল সম্পন্ন মানুষ তথা সৃষ্টির সেরা মানুষ হওয়া সত্তেও, আল্লাহর খলিফার পরিচয় ধারণ করা সত্তেও মহাগ্রন্থ আল কোরআনের প্রতি আজ আমাদের যেন কোন দায়বদ্ধতা নেই, কোন দায়িত্বানুভূতি নেই। এর কারণ কী? কারণ, আল্লাহ নয় মুরুব্বিরাই যে আজ আমাদের কাছে বড় হয়ে উঠেছেন। খোদার আসন দখল করে নিয়েছেন আজ মুরুব্বি ও মূর্খতা! কাজেই আল্লাহর কালাম ভুলুণ্ঠিত হলে আমাদের কীই বা আসে যায়, মুরুব্বির আদেশ তো মাথায় করে রাখি! (নাউযুবিল্লাহ)।

এসবই ইহুদীদের এবং পতন যুগের জাতি সমূহের লক্ষণ। কোন জাতির অধঃপতন যখন ঘনিয়ে আসতো, তখন সে জাতির কায়েমী স্বার্থবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠী সমূহ আল্লাহর কালাম থেকে লোকদেরকে দূরে রাখার জন্য বিভিন্ন ভাবে ফন্দি-ফিকির করত। যার কারণে সে জাতির জীবন-প্রণালীর সাথে আল্লাহর কালামের আর কোন যোগসূত্র থাকতো না এবং এক সময় আল্লাহ তাঁর কালামকে ঐ অভিশপ্ত জাতির কাছ থেকে উঠিয়ে নিতেন। সমাজ ও রাষ্ট্রে যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণে আল্লাহর কালাম এক সময়ে সেসব জনগোষ্ঠীর কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে এবং নানামুখি বিকৃতি ও অবহেলার শিকার হয়ে অবশেষে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

কিন্তু আল কোরআন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের সর্বশেষ কালাম হওয়ায় এটি কখনো বিকৃত ও বিলুপ্ত হবে না। কারণ সর্বশেষ কিতাব হওয়ার কারণে রাহমানির রাহিম নিজেই একে হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন। যার কারণে আরবি ভাষা না জানা সত্তেও যে কোন অনারব এ মহাগ্রন্থটি অর্থ না বুঝে শুধু তেলাওয়াতের মাধ্যমেও অশেষ ফায়েয ও তৃপ্তি লাভ করে থাকেন, যা পৃথিবীর আর কোন গ্রন্থ পাঠে সম্ভব হয় না। অর্থ না জেনে দুনিয়ার আর কোন গ্রন্থের একটি পৃষ্ঠাও কেউ ক্লান্তিহীন ভাবে পাঠ করতে সক্ষম নয়। কারণ কাজটি অর্থহীন হওয়ার কারণে অশেষ বিরক্তি ও ক্লান্তি তাকে ঘিরে ধরবে। কিন্তু মহাগ্রন্থ আল কোরআনই এমন একটি ব্যতিক্রমধর্মী গ্রন্থ যার শাব্দিক অর্থ না জানা সত্বেও লক্ষ কোটি মানুষ পরম আবেগ, আনন্দ ও তৃপ্তির সাথে প্রতিদিন তেলাওয়াত করছে এবং আধ্যাত্মিক ভাবে অশেষ উপকৃত হচ্ছে।

এটি মূলত বরকতপূর্ণ এই ঐশীগ্রন্থের একটি মোজেজা, নতুবা শুধুমাত্র তেলাওয়াত করে সওয়াব কামাইয়ের জন্যই এ মহাগ্রন্থটি অবতীর্ণ হয়নি। বরং আল কোরআন এসেছে মানুষের জীবন ও সমাজ-সভ্যতার মধ্য থেকে সকল ধরনের কুফরিকে বাতিল করে দিয়ে তার স্থলে হককে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, মূর্খতা ও জাহেলিয়াতের অন্ধকার ভেদ করে জ্ঞানের মশাল প্রজ্জ্বোলিত করার জন্য। অজ্ঞতা ও নৈরাজ্যের ধ্বংসস্তুপের উপর সভ্যতার প্রাসাদ নির্মাণের জন্য।

ইসলাম জীবনমুখি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন বিধান। মূর্খতা ও বৈরাগ্যবাদের সাথে ইসলামের দূরতম সম্পর্কও নেই। সুতরাং আজ সময় এসেছে আত্মজিজ্ঞাসার, সময় এসেছে চিন্তা-গবেষণা ও বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগানোর। কারণ যারা জ্ঞান-বিমুখ, যারা আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে ভাবে না, চিন্তা-গবেষণা করে না, যারা কুপমণ্ডুক, যারা তাদের বিবেক বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে উৎসাহী নয় তাদের সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন মহাগ্রন্থ আল কোরআনে বলেছেন :

‘এ কথা একান্তই সত্য যে, বহু-সংখ্যক জ্বিন ও মানুষ এমন আছে, যাদেরকে আমরা জাহান্নামের জন্যই সৃষ্টি করেছি। তাদের অন্তর আছে কিন্তু তারা তার সাহায্যে চিন্তা-ভাবনা করে না; তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না; তাদের শ্রবনশক্তি আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না। তারা আসলে জন্তু-জানোয়ারের মত; বরং তার চেয়েও বেশি বিভ্রান্ত। এরা চরম গাফলতির মধ্যে নিমগ্ন।’ - [আল-আরাফ : ১৭৯]

‘হে ঈমানদার লোকেরা! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং আদেশ শোনার পর তা অমান্য করো না। তাদের মত হয়ে যেয়ো না, যারা বলে, আমরা শুনলাম; কিন্তু আসলে তারা শোনে না। নিশ্চিত জেনো, আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম পশু, বধির ও বোবা হচ্ছে সেসব মানুষ, যারা নিজেদের বিবেক ও বুদ্ধিকে কাজে লাগায় না। আল্লাহ যদি জানতেন যে, তাদের মধ্যে কোন ধরনের কল্যাণ রয়েছে, তাহলে তিনি অবশ্যই তাদেরকে শোনার তওফিক দিতেন। তিনি যদি তাদেরকে শুনতে দিতেন, তবে তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চলে যেতো।’ -[আনফাল : ২০-২৩]

‘এদের মধ্যে বহু লোকই তোমার কথা শোনে। কিন্তু তুমি কি বধিরদের শোনাবে তারা না বুঝতে চাইলেও? তাদের মধ্যে বহু লোক তোমাকে দেখে, কিন্তু তুমি কি সেসব অন্ধদের পথ দেখাবে, তারা দেখতে না চাইলেও? আসল কথা হল, আল্লাহ লোকদের উপর জুলুম করেন না, বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করে। -[ইউনুস : ৪২-৪৪]

‘তারা না কারো কথা শুনতে পারতো আর না তাদের নিজেদের বুদ্ধিতে কিছু আসতো। এরা সেই লোক, যারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে আর তারা যা রচনা করেছিল, তার সব কিছুই তাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। অনিবার্যভাবে তারাই পরকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’-[হূদ : ২০-২২]

পবিত্র কোরআনই ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) ও তাঁর সাহাবীদের দাওয়াতী তৎপরতা বা গণসংযোগমূলক কাজের প্রধান হাতিয়ার। কারণ কোরআন শুধু যে সত্যের দলিল তাই নয়, কোরআন ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে মহানবীর জন্য একটি বিরাট মোজেজা। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত একটি হাদীসে মহানবী (সঃ) বলেছেন, ‘এমন কোন নবী ছিলেন না যাকে কোন মোজেজা প্রদান করা হয়নি, যা দেখে লোকেরা ঈমান আনতো। কিন্তু আমার মোজেজা হলো অহী (কোরআন), যা আল¬াহ আমার প্রতি নাযিল করেছেন। সুতরাং আমি আশা করি কেয়ামতের দিন তাদের অনুসারীদের তুলনায় আমার উম্মতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হবে।’ -[বুখারী]।

বস্তুত কোরআনের ভাষায় রয়েছে এমন এক সম্মোহনী শক্তি এবং এর বাণীতে রয়েছে মানুষের বিবেক ও চিন্তার জন্য এমন খোরাক যা কঠিন প্রাণ আরব-বেদুইনদের মনকেও বিগলিত না করে পারেনি। হযরত ওমরের মত কঠিন ও কঠোর স্বভাবের মানুষও; যিনি আল্লাহর রাসূলকে হত্যা করার জন্য উদ্যত সঙ্গীন নিয়ে রওনা হয়েছিলেন, তিনিও তো বশ মেনেছিলেন মূলত আল্লাহর কালাম আল কোরআনের বাণী শুনেই। এ কারণেই আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীদের দাওয়াতী কাজের প্রধান উপকরণ ছিল আল কোরআন। কোরআন প্রচারের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আল্লাহর নবী বলেছেন :

‘একটি আয়াত হলেও তা আমার পক্ষ থেকে প্রচার কর।’ -[বুখারী]

বিদায় হজ্জের ভাষণেও মহানবী আল¬াহর কালামের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে  বলেছেন - ‘আমি তোমাদের কাছে একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যদি তা দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধর তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব।’

দ্বীনের দাওয়াতে কোরআনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার কারণ কী ? কারণ, আল কোরআনই দ্বীনের ভিত্তি এবং দ্বীনী জ্ঞান ও হেদায়েতের মূল উৎস। হেদায়েতের পথে উম্মতের টিকে থাকাও মূলত নির্ভর করে আল কোরআনের সাথে তাদের গভীর সম্পর্কের উপর। উম্মতের রক্ষাকবচও হচ্ছে মূলত আল্লাহর কালাম আল কোরআন। মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের মূল সূত্রই হচ্ছে এই কোরআন। মানব জাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও দেখা যাবে, কোন জাতির উত্থান-পতন নির্ভর করতো মূলত আল্লাহর কালামের সাথে তারা কী ব্যবহার করতো তার উপর। আল্লাহর কালাম চিরদিনই ছিল মানব জাতির জন্য সৌভাগ্যের পরশ-পাথর। যে জাতি আল্লাহর কালামকে বুকে ধারণ করেছে, আল্লাহরকালামকে তাদের জীবনে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছে,আল্লাহর কালামকে যারা সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে, বিনিময়ে আল্লাহও তাদেরকে পৃথিবীতে গৌরবান্বিত করেছেন, সম্মান দিয়েছেন। আর পূববর্তী জাতি সমূহের অধঃপতনের মূল কারণই এই ছিল যে, তারা আল্লাহর কালাম থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। আল্লাহর কালামের পরিবর্তে তারা নিজেদের মনগড়া ধারণা-বিশ্বাস, পীর, আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তিদেরকেই হেদায়েতের উৎস বানিয়েছিল। আল্লাহর কালামের পরিবর্তে নিজেদের কথাকেই বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে পূর্ববর্তী কিতাবধারীগণ আল্লাহর  কিতাবকে বিকৃত পর্যন্তকরে ফেলেছিল।

ইহুদি আলেমদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তারা আল্লাহর নামে মিথ্যা অপবাদ দিত। অর্থাৎ নিজেদের মনগড়া কথা তারা আল্লাহর নামে চালিয়ে দিত। তারা এটি করতে পারতো এজন্য যে, সমাজের মানুষের মধ্যে আল্লাহর  কালামের যথার্থ কোন চর্চা ছিল না। ধর্মীয় নেতারা নানান বাহানায় আল্লাহর কালামের চর্চার পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া কাহিনী ও  মতবাদ চর্চার উপরই বেশি গুরুত্ব দিতেন। আর লোকেরাও আল্লাহর কালামকে পাশকাটিয়ে ধর্মীয় নেতা, বুযুর্গ ব্যক্তিদের বয়ানের দিকেই বেশি ঝুকে পড়েছিল। যার কারণে ইহদি আলেম সহ সাধারণ মানুষের মধ্যে আল্লাহর নামে আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে ও মনগড়া কথা বলা একটা রীতিতে পরিণত হয়েছিল। পবিত্র কোরআনে ইহুদিদের এ বদ অভ্যাসের কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন : ‘এর পরও যারা নিজেদের মনগড়া কথা আল্লাহর উপর আরোপ করে, প্রকৃতপক্ষে তারাই জালিম।’-[আলে ইমরান : ৯৪]

এ কারণেই, আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীগণ আল কোরআনের প্রচারকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। আল্লাহর রাসূল বেশিরভাগ সময়ই সরাসরি কোরআন শুনিয়েই মানুষকে দাওয়াত দিতেন। সাহাবীগণও তাই করতেন। তাঁদের মধ্যে কোরআনের চর্চা এত বেশি ছিল যে, একজনের সাথে আরেক জনের দেখা হলে তাঁরা পরস্পরকে কোরআনের কোন অংশ না শুনিয়ে কোন কথা বলতেন না।

পূর্ববর্তী কিতাবধারীরা দ্বীনকে বিকৃত করে, এর উপর নিজেদের যেসব মনগড়া ধ্যান-ধারণা আরোপ করেছে এবং পবিত্র কালামের যেসব শিক্ষাকে তারা গোপন করেছিল সেসব শিক্ষাকে প্রকাশ করে দেয়া, আল্লাহর দেয়া যেসব হালালকে তারা হারাম এবং হারামকে হালাল করেছিল সেসব বিকৃতিকে পরিশুদ্ধ করাও ছিল মহাগ্রন্থ আল কোরআনের আগমণের অন্যতম লক্ষ। এ কারণেও কোরআনের পয়গাম মানুষের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দেয়া ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর নবুয়তী মিশনের অন্যমত দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে আহলে কিতাবীদের উদ্দেশ্যে আল¬াহ পাক বলেছেন :

‘হে আহলি কিতাবী গণ! তোমাদের কাছে আল্লাহর রাসূল এসেছে। কিতাবের যেসব বিষয় তোমরা গোপন করতে সে তার মধ্য থেকে অনেক বিষয় প্রকাশ করে দেয় এবং অনেক বিষয় মাফ করে দেয়। তোমাদের কাছে একটি জ্যোতি ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। এরদ্বারা আল্লাহর যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে তাদেরকে নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে স্বীয় নির্দেশে অন্ধকার থেকে আলোকের দিকে নিয়ে আসেন এবং সরল পথে পরিচালিত করেন। -[আল মায়েদা : ১৫-১৬]

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অতীতের বিভ্রান্ত, জালেম, ফাসেক ও অভিশপ্তদের জাতি সমূহের মত আমাদের মধ্যেও আজ আল্লাহর কালামের চর্চা ও প্রচার-প্রসার কমে গেছে এবং আমাদের দ্বীনদার লোকদের মধ্যে আল্লাহর কালামের পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া কথা ও ধারণা-বিশ্বাসকে প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজেদের জীবন থেকে আল কোরআনের শিক্ষাকে বিদায় করে দিয়ে আজ আমরা অভিশপ্ত ইহদী-নাসারাদের পদাংক অনুসরণ করছি। আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য সকল ক্ষেত্রেই আমরা পাশ্চাত্যের আদর্শকে অনুসরণ করে চলেছি। পাশ্চাত্যের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আমরা ধর্মকে, ঐশী আদর্শ আল কোরআনের শিক্ষাকে অত্যন্ত সংকীর্ণ ও সীমিত ক্ষেত্রে আবদ্ধ করে ফেলেছি। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করতে যেয়ে আমরা তোতা পাখির মত তাদের শিখানো বুলি আবৃত্তি করে বলছি ‘ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা।’ এই আপ্তবাক্যকে আল্লাহর নির্দেশের চেয়েও বেশি মর্যাদা দিয়ে শুধু রাজনীতি নয় সমাজ-সংস্কৃতির সর্ব পর্যায়ে আল কোরআনের প্রবেশাধিকারকে নিষিদ্ধ করতে এবং সত্য গোপন করতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ, আমাদের শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আমাদের প্রচার মাধ্যম এমনকি দ্বীনের তথাকথিত মেহনতকারীরাও উঠে পড়ে লেগেছেন। অথচ আল কোরআন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। আল্লাহ বলেছেন :

‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) মনোনীত করলাম।-[আল মায়েদা :৩]

এই পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের অনুসরণ করার নির্দেশই দিয়েছেন আল্লাহর রাব্বুল আ’লামীন :

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে দাখিল হও আর শয়তানের পদাংক অনুসরণ ক‘রো না; নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।’-[বাকারা : ২০৮]

রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় মহাগ্রন্থ আল কোরআনের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। নামাজ-রোজার মত আল্লাহর এসব হুকুম পালন করা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রেই আল্লাহর আনুগত্য, তাঁর দাসত্ব ও গোলামী করাই হচ্ছে ঈমানের অনিবার্য দাবী। কিন্তু রাজনীতি সহ সমাজ-সংস্কৃতির সর্ব স্তর থেকে ইসলাকে নির্বাসিত করা সত্যকে গোপন করারই নামান্তর এবং এটি ইহুদীদেরই অন্যতম বৈশিষ্ট। নিজেদের স্বেচ্ছাচারীতাকে বজায় রাখার জন্য আল্লাহর কালামের কিছু মানা এবং কিছু না মানার কারণে আল¬াহ রাব্বুল আ’লামীন ইহুদীদের তীব্র সমালোচনা এবং করেছেন এবং এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। যারা ইসলামকে খণ্ডিত ও সংকীর্ণরূপে তুলে ধরে; স্বার্থের বশবর্তী হয়ে কিংবা মূখতা বশত যারা আল কোরআনের কোন আদর্শকে, আল্লাহর নূরকে তথা সত্যকে গোপন করে তাহলে তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর অভিশাপ আর আখেরাতে রয়েছে কঠিন আযাব :
‘তাহলে কি তোমরা আল্লাহর কিতাবের একাংশ বিশ্বাস কর আর অপর অংশকে কর অবিশ্বাস? জেনে রেখো, তোমাদের মধ্যে যারাই এ ধরনের আচরণ করবে তাদের জন্য রয়েছে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা ও অপমান আর পরকালের জীবনে কঠিন আযাব। তোমরা যা কিছুই কর আল্লাহ সে সম্পর্কে বেখবর নন।’ -[আল-বাকারা : ৮৫]

করে, সেসব লোকের প্রতিই রয়েছেআল্লাহর অভিশাপ এবং অভিশাপ বর্ষণকারীদেরও অভিশাপ।’ -[বাকারা : ১৫৯]
‘এসব আহলি কিতাবদেরকে সেসব ওয়াদাও স্মরণ করিয়ে দাও, যা আল্লাহ তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন। তা এই যে, তোমাদেরকে কিতাবের শিক্ষা লোকদের মধ্যে প্রচার করতে হবে, তা গোপন করতে পারবে না। কিন্তু তারা কিতাবকে পিছনে ফেলে রেখেছে এবং সামান্য মূল্যে তাকে বিক্রয় করেছে। তারা এই যা কিছু করছে তা কতই না খারাপ কাজ!’ -[আলে ইমরান : ১৮৭]

আজ বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের যে বিপর্যয়, যে জিল্লতি ও অপমান চেপে বসেছে তা কি আল্লাহর কালামের সাথে আমাদের দুর্বব্যবহার এবং সত্যকে গোপন করার কারণে নয়? #

Comments

Popular posts from this blog

ক্যারিয়ার গাইড: টেলিসেলস এক্সিকিউটিভ/কাস্টমার সার্ভিস রিপ্রেজেন্টেটিভ বা গ্রাহকসেবা প্রতিনিধি

যৌবনের যত্ন [চার]: পুরুষ হরমোন ঘাটতির ১০টি লক্ষণ

যৌবনের যত্ন [তিন]: পুরুষদের দেহে টেস্টোস্টেরনের প্রভাব