রোজা কী, কেন, কীভাবে?

মাওলানা মুজাম্মিল সিদ্দিকী 

অনুবাদ: মুহাম্মদ আবুল হুসাইন
রোজা কী?
আল কোরআনের পরিভাষায় রোজাকে বলা হয়‘ সাওম’। আরবি ‘সাওম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘বিরত থাকা’। এ প্রসঙ্গে সূরা মরিয়মে উল্লেখিত হযরত ঈসা (আ.)’র মা  হযরত মরিয়মের একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করা যায়: ‘আমি পরম করুণাময়ের জন্য রোজার মানত করেছি। এ কারণে আজ আমি কারও সাথে কথা বলব না।’ -সূরা মরিয়ম: আয়াত ২৬। এখানে মা মরিয়মের বক্তব্য থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, যেহেতু তিনি রোজা রেখেছেন, সেহেতু তিনি কারো সাথেই কথা বলা থেকে বিরত থাকবেন। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ‘সাওম’ বলতে বুঝায়, ‘আল্লাহ’র সন্তুষ্টির আশায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার খাদ্য-পানীয় এবং যৌনতা থেকে বিরত থাকা।

রোজা কেন রাখব?
১.রোজার উদ্দেশ্য
পবিত্র কোরআন মজিদে রোজা বা সাওম সাধনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরাজ করা হল যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাক্বওয়ার গুণাবলী অর্জন করতে পারো।’ -(সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৮৩)।
তাক্বওয়া আল কোরআনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক পরিভাষা। এটি ইসলামী আধ্যাত্মবাদ এবং নৈতিকতার মূলকথা। এটি ঈমানদার বা বিশ্বাসীদের জীবনের একটি একটি গুণাবলী যার বলে তারা তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে চিন্তা এবং কর্মে আল্লাহ’র অস্তিত্বকে অনুভব করে, তাঁকে স্মরণ করে, তাঁকে হাজির-নাজির জেনে এবং ভয় করে নিজেদের জীবন পরিচালনা করেন। যার মধ্যে তাক্বওয়ার গুণাবলী রয়েছে, তিনি সর্বাবস্থায় আল্লাহ’র জন্য নেক আমল করতে এবং গুনাহ বা নাফরমানি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে ভালোবাসেন। তাক্বওয়া হল এমন এক নৈতিক বোধ, যার ফলে ঈমানদারগণ নেক আমল করতে এবং আল্লাহ’কে ভয় করে চলতে ব্রতী হয়। তাক্বওয়া মানুষের মধ্যে ধৈর্য্য এবং দৃঢ়তা তৈরি করে। এটি মানুষের মধ্যে সহনশীলতা তৈরি করে এবং ধৈর্য্য ও সহনশীলতা মানুষকে উচ্চ নৈতিকতার স্তওে উন্নীত হতে সাহায্য করে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, রোজা ঢাল স্বরূপ, যা মানুষকে গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। শিস্যরা যখন জেসাসকে অনৈতিকতাবোধ থেকে বেঁচে থাকার উপায় জানতে চাইলেন, তখন তিনি তাদেরকে বললেন, প্রার্থনা এবং উপবাস ছাড়া তা সম্ভব নয়। -(ম্যাথিউ ১৭:২১)।
ইমাম গাজ্জালী (র.)’র মতে, রোজা মানুষের মধ্যে সামাদীয়াহ’র মত নৈতিক গুণ তৈরি করে, যা তাকে আকাক্সক্ষা থেকে মুক্তি দেয়। ইমাম ইবনে আল কাইয়ুম (র.) রোজাকে দেখেছেন আকাক্সক্ষার নিয়ন্ত্রক হিসেবে, যা ইন্দ্রিয়পরায়ণতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (র.) মনে করেন, রোজা মানুষের ভিতরকার কুপ্রবৃত্তি বা পশুশক্তিকে দুর্বল করে এবং সুপ্রবৃত্তি বা বিবেকবোধকে শক্তিশালী করে। মাওলানা মওদূদী (র.) পবিত্র রমজান মাসকে দেখেছেন ব্যক্তিগতভাবে একজন মুসলমানের জন্য এবং সমগ্রভাবে পুরো মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ধৈর্য্য এবং আত্মশুদ্ধির মাস হিসেবে।

রোজা কীভাবে রাখব?

রোজার নিয়ম

১. কার উপর রোজার ফরজ: পবিত্র রমজান মাসে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক (সাবালক প্রাপ্ত) নারী ও পুরুষের রোজা ফরজ যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ-স্বাভাবিক এবং যারা ভ্রমণরত নয়। যাদের অসুস্থতা সাময়িক এবং শীঘ্রই আরোগ্য লাভের আশা আছে তাদের জন্য অসুস্থকালীন সময়ে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। তবে রমজানের পর তাদেরকে অবশ্যই ছুটে যাওয়া রোজাগুলো পূর্ণ করতে হবে। আর যাদের অসুস্থতা আরোগ্যযোগ্য নয় বা শীঘ্রই ভালো হওয়ার কোন আশা নেই তাদেরকেও রোজা না রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং পরবর্তীতে তাদেরকে ছুটে যাওয়া রোজা রাখতেও হবে না; তবে তাদেরকে অবশ্যই ফিদিয়া আদায় করতে হবে। প্রতিটি ছুটে যাওয়া রোজার ফিদিয়া হচ্ছে একজন দরিদ্র মানুষকে একদিনের খাদ্য বা সমপরিমাণ অর্থ প্রদান। নারীদেরকে তাদের মাসিক চলাকালীন সময়ে (হায়েয) কিংবা প্রসূতিকালীন রক্ত¯্রাবের সময়ে (নিফাস) রোজা রাখার অনুমতি দেয়া হয়নি। তবে তাদেরকে অন্য সময়ে অবশ্যই ছুটে যাওয়া রোজাগুলো সম্পন্ন করতে হবে। এছাড়া গর্ভবতী এবং প্রসূতি নারীদের যারা সন্তানকে দুধ পান করান তাদের পক্ষে রোজা রাখা যদি কষ্টকর হয়, তাহলে তাদের জন্যও রোজা না রাখার অনুমোদন রয়েছে; তবে সুবিধাজনক সময়ে তাদেরকেও অবশ্যই না রাখা রোজাগুলো পূর্ণ করতে হবে।

২. সফরের সময়ে রোজা না রাখার বিধান রয়েছে। যে কোন সফর তা যদি নিজ শহরের বাইরে হয় এবং কমপক্ষে ৪৮ মাইল বা ৮০ কিলোমিটারের দরত্বের হয়, তাহলে সেই সফরের সময় রোজা না রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে সফরের জন্য উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে। কেউ যদি রোজা না রাখার উদ্দেশ্যে অহেতুক সফরে যায় তাহলে তা হবে গুনাহ’র কাজ। বরং একজন মুসলমানের উচিত হবে ফরজ রোজা পালনের স্বার্থে রমজান মাসে সফরের কর্মসূচী পরিবর্তন করে অন্য সময়ে তা নির্ধারণ করা।

৩. রোজার সুন্নত:

ক. সেহরি খাওয়া। এটি রাসূলের সুন্নত এবং সেহরি গ্রহণের মধ্যে অনেক পুরুষ্কার এবং বরকত রয়েছে। সেহরির সর্বোত্তম সময় হল সুবহে সাদিকের আধা ঘন্টা পূর্ববর্তী সময়।

খ. সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ইফতার গ্রহণ করা এবং অহেতুক দেরী না করা।

গ. অহেতুক এবং মিথ্যা কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। ঝগড়া-বিবাদ না করা, গালিগালাজ এবং অশ্লীল কথা না বলা। হারাম এবং অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকা। মুখ, ঠোট শুকনো রেখে এবং মনমরা ভাব প্রকাশ করে রোজার প্রদর্শনী না করা।

ঘ. বেশি বেশি দান-খয়রাত করা, ভাল কাজ করা, নফল নামাজ পড়া, কোরআন পাঠ করা। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত রমজান মাসে অন্তত একবার কোরআন খতম করা।
৪. যেসব কাজে রোজা ভঙ্গ হয় : 
রোজা রাখা অবস্থায় এমন কোন কাজ করা উচিত নয় যা আমাদের রোজা নষ্ট করে দেয়। যেসব কাজে রোজা নষ্ট হয় এবং কাজা করতে হয় সেগুলো হল:
১. ইচ্ছাকৃতভাবে খাওয়া, পান করা কিংবা ধূমপান করলে রোজা নষ্ট হবে। এছাড়া নাক, মুখ বা পায়ুপথে অপুষ্টিকর কোনকিছু প্রবেশ করালেও রোজা নষ্ট হবে এবং কাজা করতে হবে।
২. ইচ্ছাকৃতভাবে নিজে নিজে বমি করলে রোজা নষ্ট হবে।
৩. নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক শুরু হলে অথবা সন্তান জন্ম দেয়ার পর রক্তপাতের সময়। ইফতারের আগ মুহূর্তেও যদি মাকিস শুরু হয় তাহলেও রোজা নষ্ট হবে এবং পরে কাজা করে নিতে হবে।
৪. যৌন সঙ্গম অথবা অন্য কোন ভাবে যৌন তৃপ্তি লাভ করা। যেমন পুরুষের ক্ষেত্রে হস্তমৈথুন, যার ফলে বীর্যপাত হয় এবং নারীদের ক্ষেত্রে যোনিপথ থেকে কিছু নিঃসরণ হলে।
৫. এখনও ফজরের সময় হয়নি এরকম ভূল ধারণা করে ফজরের পরে খাদ্য-পানীয় গ্রহণ, ধূমপান কিংবা যৌনসঙ্গম করলে। অনুরূপভাবে ইফতারির সময় হয়েছে মনে করে সূর্যাস্তের পূর্বেই উপরোক্ত কাজ গুলো করলে। উভয় অবস্থায় রোজা ভঙ্গ হবে এবং কাজা করতে হবে।
৬. রোজা অবস্থায় যৌনসঙ্গম নিষিদ্ধ এবং কবিরা গুনাহ। কাজেই যারা এ কাজে লিপ্ত হবে তাদের উভয়ের রোজা তো ভাঙবেই ; কাজা এবং কাফ্ফারা আদায় করতে হবে এবং অবশ্যই তওবা করতে হবে। এই কঠিন অপরাধের কাফফারা হল রমজান মাসের পর প্রত্যেককে একটানা ৬০টি রোজা রাখতে হবে অথবা ৬০ জন গরীব লোককে ১ দিনের খাদ্য বা সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হবে। এটি হল এভাবে ইচ্ছাকৃতভঅবে একটি রোজা ভাঙ্গার শাস্তি। একাধিক হলে শাস্তিও এই অনুপাতে বেশি হবে। ইমাম আবু হানিফর মতে ইচ্ছাকৃত ভাবে কেউ খাদ্য-পানীয় গ্রহণ করে রোজা ভাঙলে তার জন্যও একই ভাবে কাফ্ফারা প্রযোজ্য হবে।

৫. যেসব কাজে রোজা ভঙ্গ হয় না
রোজা অবস্থায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বৈধ:
১) গোসল করা বা শরীর ধোয়া। বেশিরভাগ ফেকাহবিদদের মতে, রোজা রাখা অবস্থায় সাঁতারকাটা বৈধ। তবে ডুব দেয়া পরিহার করা ভাল; কেননা তাতে মুখ বা নাক দিয়ে পেটের ভিতর পানি চলে যাওয়ার আশংকা থাকে। তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভিতর পানি চলে গেলে তাতে রোজা নষ্ট হবে না।
২) সুগন্ধি বা পারফিউম ব্যবহার করা, চোখে কন্টাক্ট লেন্স পড়া এবং আই ড্রপ দেয়া যাবে।
৩) ইনজেকশন নেয়া কিংবা রক্ত পরীক্ষা করানো যাবে।
৪) মিশওয়াক, টুথপেস্ট সহ টুথ ব্রাশ এবং গরগর না করে কুলি করা এবং সতর্কতার সাথে পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করা যাবে। অজুর সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে কুলি কিংবা নাকে পানি দেয়ার সময় গলার ভিতর পানি চলে না যায়।
৫) ভুলে খাদ্য, পানীয় গ্রহণ বা ধূমপান করলে রোজা ভঙ্গ হবে না। তবে রোজা রাখার কথা মনে হওয়ার সাথে সাথে খ্যাদ্য, পানীয় গ্রহণ কিংবা ধূমপান বন্ধ করতে হবে এবং রোজা অব্যাহত রাখতে হবে।
৬) দিনের বেলা ঘুমালে কিংবা স্বপ্নদোষ হলে রোজা ভঙ্গ হয় না।
৭) ফজরের পূর্বে গোসল ফরজ হওয়া অবস্থায় গোসল করতে না পারলে রোজা ভঙ্গ হবে না, তবে দেরি না করে নামাজের পূর্বে অবশ্যই গোসল করে নামাজ আদায় করতে হবে।
৮) রাতের বেলা যদি কোন নারীর হায়েয বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তিনি রোজা রাখতে পারবেন। তবে নামাজের আগে অবশ্যই গোসল করতে হবে।
৯) সহবাসের পর ঘুমিয়ে গেলে এবং ঘুমের কারণে সেহরি এমনকি ফজরের নামাজ কাজা হলেও রোজা ভঙ্গ হবে না। তবে এমনটি রোজার স্পিরিটের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
১০) সংযমি হতে পারলে রোজা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর চুম্বন নিষিদ্ধ নয়; তবে সংযমি হতে না পারলে এটি পরিহার করাই শ্রেয়, কেননা রোজা অবস্থায় সহবাস একেবারেই নিষিদ্ধ।

৬. রোজা শুদ্ধ হওয়ার জন্য যা করণীয়
রোজা শুদ্ধ হওয়ার জন্য রয়েছে দুটি মৌলিক উপাদান, যেগুলো অবশ্যই পূরণ করতে হবে:
১. নিয়ত: প্রত্যেকদিন সুবহে সাদিকের পূর্বে আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্য অবশ্যই আন্তরিকভাবে রোজার নিয়ত করতে হবে। নিয়ত মুখে উচ্চারণ বাধ্যতামূলক নয়, তবে হৃদয় ও মনে যথাযথ উপলব্ধি অবশ্যই প্রয়োজন। কোন কোন ফকিহ’র মতে রমজানের শুরুতে একবার নিয়ত করলেই হবে প্রত্যেকদিন নিয়ত করার প্রয়োজন নেই। তবে রোজার পূর্ণ ফায়দা এবং ফজিলত হাসিল করতে প্রত্যেকদিন ফজরের পূর্বে আন্তরিক নিয়তের কোন বিকল্প নেই।
২. সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল ধরনের নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা। যে ধরনের (নিষিদ্ধ) কাজে রোজা ভঙ্গ হয় তা ইতোমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে।

Comments

Popular posts from this blog

ক্যারিয়ার গাইড: টেলিসেলস এক্সিকিউটিভ/কাস্টমার সার্ভিস রিপ্রেজেন্টেটিভ বা গ্রাহকসেবা প্রতিনিধি

যৌবনের যত্ন [চার]: পুরুষ হরমোন ঘাটতির ১০টি লক্ষণ

যৌবনের যত্ন [তিন]: পুরুষদের দেহে টেস্টোস্টেরনের প্রভাব