ধর্ম ও বিবেক: ইসলামী দৃষ্টিকোণ

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন:


বিবেকের দোহাই দিয়ে দ্বীন-ধর্মকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার একটি প্রবণতা আধুনিক শিক্ষিত এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে লক্ষ করা যায়। তারা সেকুলার ও বস্তুবাদী জীবন-দর্শনের প্রচার এবং ধর্মমুক্ত জীবন-যাপনের নসীহত দিতে গিয়েই এমনটি করে থাকেন। তাদের মতে, মানুষের বিবেকই তার ধর্ম। বিবেকের কথা মত চলতে পারলে কোরআন কিতাবের প্রয়োজন পড়ে না। আপাত দৃষ্টিতে এ কথাগুলোর মধ্যে চটকদারিতা থাকলেও বস্তুনিষ্ঠতার দিক থেকে চিন্তা করলে তার অন্তঃসারশূন্যতা সহজেই ধরা পড়ে। বিবেকের বড়াই করে যারা দ্বীন-ধর্মকে বিসর্জন দিতে চান; তারা এর মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত যে বলগাহীন প্রবৃত্তির অনুরণকেই কবুল করে নেন তা হয়তো তারা নিজেরাও বুঝে উঠতে পারেন না। আসলে ধর্মহীন সেকুলার জীবন-দর্শনের অন্ধ অনুসরণকে বৈধতা দিতেই তারা এসব কথা বলে থাকেন। সহজ-সরল ও কোমলমতি তরুণদেরকে নাস্তিক্যবাদের দিকে ঠেলে দেয়ার এটি তাদের একটি বিশেষ কৌশল। আমরা মনে করি এটি শয়তানের একটি মারাত্মক কুমন্ত্রণা। শয়তানের বিশেষত্ব হল, যে যেমন তার কাছে সে বেশ ধরেই হাজির হওয়া। যারা বিবেকবোধকে লালন করেন তারা মানব সমাজের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভাল মানুষ। শয়তানের কাজ হচ্ছে বিবেকবান মানুষগুলোকে বিবেকের দোহাই দিয়েই বিবেকহীনতার পথে নিয়ে যাওয়া। খোদাবিমুখ সেকুলার শিক্ষা-দর্শনের প্রভাবে আধুনিক মননে ধর্মের প্রতি যে উন্নাসিকতা আগে থেকেই বদ্ধমূল হয়ে আছে, শয়তানের এ ওসওয়াসা তাদের প্রতি খুব বেশি কার্যকরী হতে দেখা যায়। অথচ ধর্মের কাজ হচ্ছে মানুষের বিবেকবোধকে জাগ্রত করে তাকে আরো শাণিত করা, সজিব করা। অনেক বিবেকবান মানুষকেই দেখা গেছে বিবেকের দোহাই দিয়ে ধর্মমুক্ত পথে চলতে গিয়ে নৈতিকতার শাশ্বত-সুন্দর পথ ছেড়ে নিজের অজান্তেই ঢুকে পড়েছেন পাশবিকতার অন্ধকার গলির পঙ্কিলতায়। বিশেষ করে আজকের তরুণ সমাজের বিপদগামীতার মূলেই রয়েছে শয়তানের এই ওসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা। তরুণ প্রাণ স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছল-চঞ্চল। কিন্তু তাই বলে তারা বিবেকহীন নন। বরং তারুণ্যের শক্তির মতই মানব জীবনের বিবেকশক্তিও এ সময়েই থাকে সবচেয়ে সজীব, সবল। তরুণ প্রাণ তাই আর সবার চেয়ে সরল, নিস্কলুষ। এই সহজ-সরল তরুণদেরকে ধর্মের নৈতিক বন্ধন থেকে বল্গাহীন স্বাধীনতার দিকে তথা অনৈতিকতার দিকে ঠেলে দেয় এসব শয়তানী কুমন্ত্রণা। শয়তান কখনো ভাল মানুষের বেশ ধরে, কখনো বন্ধুর ঘারে সওয়ার হয়ে, কখনো আঁতেল শিক্ষকের ঘারে সওয়ার হয়ে কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের বিপদগামী করে। তারা অত্যন্ত সুকৌশলে বিবেক ও ধর্মের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দেয়। কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে বিশেষ করে ইসলাম সম্পর্কে যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি না থাকার কারণে খুব সহজেই তারা বিভ্রান্ত হয়ে ধ্বংসের দিকে পা বাড়ায়। আসলে নৈতিকতা ও বিবেকের সাথে ধর্মের - বিশেষ করে ইসলামের রয়েছে সেই সম্পর্ক, যে সম্পর্ক পানির সাথে মাছের। পানি ছাড়া যেমন মাছের অস্তিত্ব কল্পণা করা যায় না, তেমনি দ্বীন-ধর্ম ছাড়াও নৈতিকতা ও বিবেকের অস্তিত্ব কল্পণা করা যায় না।

বিবেকবান মানুষ মাত্রই একটি সুন্দর, সুশীল সমাজের প্রত্যাশা করেন।কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের জন্য মানুষের চিন্তা ও মানসিকতার পুনর্গঠন ও পরিশোধন জরুরী। মানুষের নৈতিকতা ও বিবেকবোধের শুভ উদ্বোধন ছাড়া সুশীল সমাজের কামনা দুরাশা মাত্র। আর মানুষের নৈতিক বা বিবেকবোধের এ শুভ উদ্বোধনে ধর্মের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। কারণ ধর্ম কেবল উত্তম চরিত্র, নৈতিকতা ও বিবেকবোধের আহবান জানিয়েই ক্ষান্ত হয় না, বরং চরিত্র গঠনের জন্য বাস্তব দিকনির্দেশনাও প্রদান করে থাকে। ধর্ম নৈতিক চরিত্রের বিধি-বিধান, রীতি-নীতি ও মৌল আদর্শ নির্ধারণ করে দেয়। এমনকি আচার-আচরণের খুঁটি-নাটি দিকও বলে দেয়। চারিত্রিক আদর্শের উপর দৃঢ় ও অবিচল থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করে আমাদেরকে ধর্মই। নৈতিকতা, বিবেক ও চরিত্র হারালে কী নির্মম পরিণতি হতে পারে সে ব্যাপারে ধর্মই আমাদেরকে সতর্ক ও সজাগ করে দেয়। আবার চরিত্রবান ব্যক্তিকে স্বর্গের সুসংবাদ ধর্মই শুনিয়ে থাকে। ধর্ম হচ্ছে নৈতিকতা তথা বিবেকবোধের প্রাণশক্তি আর নৈতিকতা ও বিবেক হচ্ছে ধর্মের অবয়ব। যেখানে ধর্ম সেখানেই বিবেক, আর যেখানে বিবেক সেখানেই ধর্ম। এ দুটো জিনিস অবিভাজ্য ও একক। ধর্মই ব্যক্তির মন-মানসিকতা ও বিবেকবোধকে নৈতিক চরিত্রের ভিত্তিতে জীবন্ত ও সজীব রাখে এবং তাকে উৎকর্ষ দান করে। মানুষকে উচ্চতর লক্ষ পাণে চলার জন্য উদ্বুদ্ধ করে ধর্মই। মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করা, তার সীমা নির্দিষ্ট করা এবং তা লংঘন করা থেকে তাকে ও অন্যকে বিরত রাখাই ধর্মের কাজ। সুতরাং ধর্মের প্রতি অনীহা নয়, বরং শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পৃথিবীতে বহু ধর্ম বিদ্যমান। এখানে আমরা পৃথিবীর সর্বশেষ ঐশীধর্ম ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা করে দেখাতে চেষ্টা করব ধর্ম কি আসলেই বিবেকের প্রতিপক্ষ নাকি পৃষ্টপোষক।
ধর্ম ও বিবেক: ইসলামী দৃষ্টিকোণ [২]
মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

ধর্ম:

সাধারণভাবে ধর্ম বা religion বলতে সাধারণত অতিপ্রাকৃত বিষয়, স্রষ্টা বা ঐশ্বরিক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাস, নৈতিক মূল্যবোধ, বিধি-বিধান ও প্রথা ইত্যাদি বিষয়ের উপর বিশ্বাস এবং এসবের অনুশীলন বুঝায়। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ধর্ম মানুষকে প্রদান করে এক বিশেষ জ্ঞান, উপস্থাপন করে এমন এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবনবোধ যা সাধারণ অবস্থায় মানুষের জ্ঞান বা বোধগম্যতার অতীত। ধর্মীয় বিশ্বাসের সিংভাগ বিষয় বা বলা যায় মূল বিষয় সমূহ মানুষের জাগতিক বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান দ্বারা স্পর্শযোগ্য নয়। এক অপার্থিব বা অদৃশ্য জগতের সংবাদ বা জ্ঞানের উপরই ধর্মের মূল ভিত্তি স্থাপিত। বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তা আপাত অতিপ্রাকৃত এবং যুক্তিবাদের অতীত বিষয় বলে মনে হয়। তর্কের পরিবর্তে তাই বিশ্বাসই এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে ইংরেজি religion-কে অনেক সময় faith বা belief system- বলেও অভিহিত করা হয়। ইংরেজি religion সম্পর্কে তাই encyclopedia-য় বলা হয়েছে :sometimes used interchangeably with faith or belief system–is commonly defined as belief concerning the supernatural, sacred, or divine, and the moral codes, practices, values, institutions and rituals associated with such belief.

তবে অতিপ্রাকৃত, অদৃশ্য বা অবাস্তব যাই বলি না কেন, বিশ্বব্যবস্থার অনেক অদৃশ্য অথচ বাস্তব ও অপরিহার্য বিষয়ের মতই ধর্ম মানুষের জীবনকে সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই প্রভাবিত করে আসছে। আধুনিক কালে ধর্মকে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বহু বিতর্ক হলেও ধর্মের প্রভাব, আবেদন ও নিয়ন্ত্রণ থেকে কিন্তু মানুষ মুক্ত হতে পারছে না বরং দিন যতই যাচ্ছে ধর্মের আবেদন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ধর্ম মানুষের জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠছে। পৃথিবীর সর্বশেষ ধর্ম ইসলামের কথা আমরা এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে পারি এজন্য যে, শত বৈরী প্রচারণা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এবং বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের তেমন কোন প্রভাব-প্রতিপত্তি না থাকলেও ধর্ম হিসেবে ইসলামের প্রভাব শুধু মুসলিম বিশ্বেই নয়; সেকুলার বিশ্বেও ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্মতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কাজী নূরুল ইসলাম খুব চমৎকার কথা বলেছেন। ধর্মের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ধর্মের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা বুঝতে হলে প্রথমেই দেখতে হবে ধর্ম বলতে আমরা কী বুঝি? ধর্ম কথাটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো, যা কিছু ধারণশক্তিযুক্ত তা-ই ধর্ম। এছাড়া অন্যকিছু নয়। যে আদর্শ বিশ্বকে ধরে রেখেছে এবং যে তত্ত্ব থাকাতে বস্তু তার স্বকীয়তায় ব্যক্ত হয়, সেটাই ধর্ম। যেমন – আগুনের ধর্ম হলো তাপ ও আলো। এরূপ জগতের সব কিছুরই ধর্ম আছে এবং সঙ্গত কারণে মানুষেরও একটা ধর্ম থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের এই ধর্ম কী ? মানুষের মাঝে যেসব গুণ থাকলে মানুষকে মানুষ বলা যায় এবং না থাকলে মানুষ বলা যায় না, সেসব গুণই মানুষের ধর্ম। এ গুণগুলোকে এক কথায় বলা হয় মনুষ্যত্ব। এই মনুষ্যত্বই মানুষকে মানুষ করেছে এবং এটাই হচ্ছে মানুষের ধর্ম। মানুষের ধর্মের লক্ষণ : সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, চিত্তসংযম, চুরি না করা, বিদ্যা, বুদ্ধি, সত্য ও অক্রোধ। … এখন আসছি ধর্মের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। আমরা জানি, একটা গরু জন্মগ্রহণ করে গরু হিসেবে এবং মরেও গরু হিসেবে। তাকে গরুত্ব অর্জন করতে হয় না। এটা যে কোনো পশু-পাখির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু মানুষকে জন্মের পর মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। মনুষ্যত্ব অর্জন না করলে সে অমানুষেও পরিণত হতে পারে। ধর্মের প্রধান কাজ হলো মানুষকে সত্যিকার অর্থে মানুষ বানানো, আদর্শ মানুষ বানানো। প্রত্যেকটি মানুষ যদি আদর্শ মানুষ হয় তবে প্রত্যেকটি পরিবার আদর্শ পরিবারে পরিণত হবে। প্রত্যেকটি পরিবার আদর্শ পরিবার হলে এর সঙ্গে সম্পর্কিত সমাজ আদর্শ সমাজ হবে এবং এর ফলশ্র“তিতে একটা জাতি আদর্শ জাতিতে, একটা দেশ আদর্শ দেশে এবং পরিণামে গোটা বিশ্ব একটা আদর্শ বিশ্বে পরিণত হবে। অতএব, একটা শিশুকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা যেমন ঠিক; তেমনিভাবেই আদর্শ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় ধর্মের ভূমিকাও তেমন।’

ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ম
বাংলা ভাষায় আমরা যাকে ‘ধর্ম’ বলছি আল কোরআনের পরিভাষায় তাকে বলা হয়েছে دين দ্বীন। বাংলা ‘ধর্ম’ শব্দের আবিধানিক অর্থ শাস্ত্রনির্দিষ্ট বিধি-বিধান; সৎ বা পুণ্যকর্ম; ন্যায়-অন্যায় বা পাপ-পুণ্যের বিচারকর্তা; বিশ্ববিধাতা; মনুষ্যত্ব বা মানুষের কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান; আইন-রীতি ইত্যাদি।  আরবী ভাষায় আভিধানিকভাবে دين (দ্বীন) শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন :

  • শক্তি-ক্ষমতা; শাসন কর্তৃত্ব; অপরকে আনুগত্যের জন্যে বাধ্য করা, তাকে গোলাম ও আদেশানুগত করা ইত্যাদি।
  • দাসত্ব-আনুগত; সেবা; কারো জন্য বশীভূত হয়ে যাওয়া; কারো নির্দেশাধীন হওয়া; কারো প্রভাব-প্রতাপে নিস্পেষিত হয়ে তার মোকাবেলায় অপমান সহ্য করে নেয়া; আনুগত্যপরায়ণ ইত্যাদি। আরবি ভাষায় আনুগত্যপরায়ণ জাতিকে বলা হয় قوم دين (কওমুন দাইয়্যেনুন)।
  • শরীয়ত; আইন-কানুন; পথ-পন্থা; মিল্লাত; রসম-প্রথা; অভ্যাস ইত্যাদি।
  •  কর্মফল; বিনিময়; প্রতিদান; ক্ষতিপূরণ; ফায়সালা; হিসাব-নিকাশ; বিচারক ইত্যাদি।
  • আল কোরআনে دين  দ্বীন শব্দটি আরো ব্যাপক অর্থ ও তাৎপর্যে বিকশিত হয় এবং এটি ইসলামের একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষার মর্যাদা লাভ করে। আল কোরআনেও دين শব্দের চার ধরনের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন :


  1. স্রষ্টার সর্বোচ্চ, সার্বিক ও সার্বভৌম ক্ষমতার প্রভাব-প্রতিপত্তি ও আধিপত্য অর্থে।
  2. আল্লাহর সর্বোচ্চ-সার্বভৌম ক্ষমতার সামনে মাথা নত করা, তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য অর্থে।
  3. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাঁর নিকট আত্ম-সমর্পণের ভিত্তিতে গঠিত জীবনবোধ ও জীবনবিধান, আল্লাহর আইন, বিধান ও নিয়ম-নীতি; ইসলামের অনুসৃত পথ-পন্থা ইত্যাদি অর্থে এবং
  4. বিচার, প্রতিফল, পুরষ্কার ও শাস্তি, হিসাব-নিকাশ, ফয়সালা ইত্যাদি অর্থে।

আর সামষ্টিকভাবে আল কোরআনের পরিভাষায় دين বলতে একটি পরিপূর্ণ জীবন-বিধান বা আল্লাহর আনুগত্যের সার্বিক বিধান ইসলামকে বুঝায়। আল কোরআনের পাতায় পাতায় দ্বীন সম্পর্কে যত আলোচনাই করা হয়েছে তাতে আল্লাহর সর্বোচ্চ ক্ষমতা, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌম ক্ষমতার কথা ঘোষিত হয়েছে এবং মানুষকে বলা হয়েছে সে সার্বভৌম সত্তার সামনে আত্মসমর্পণ করে তাঁর সামনে সম্পূর্ণ ও একান্তভাবে আনুগত্যের মস্তক অবনত করতে এবং সাথে সাথেই বলা হয়েছে যে, এটাই সঠিক দ্বীন বা জীবনপথ; এতেই রয়েছে মানুষের জন্য ইহকালীন এবং পরকালীন শান্তি ও সফলতা। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল কোরআনের এ সম্পর্কিত কিছু ভাষ্য এখানে উল্লেখ করা যায় :
‘তিনি আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্যে জমিনকে বাসস্থান করেছেন আর আসমানকে করেছেন ছাদ স্বরূপ। তিনি তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন আর তাকে ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন। তিনি পবিত্র বস্তু থেকে তোমাদের রিজিক সরবরাহ করেছেন। সে আল্লাহই তোমাদের প্রভু। বিশ্ব-জাহানের প্রতিপালক এবং মহান মর্যাদা ও সমৃদ্ধির মালিক। তিনি চিরঞ্জীব। কার্যত তিনি ছাড়া আর কেউ যথার্থ হুকুমকর্তা ও বিধানদাতা নেই। সুতরাং দ্বীনকে (আনুগত্য বা  জীবন-ব্যবস্থাকে) একান্তভাবে তাঁর জন্যেই নির্দিষ্ট করে তোমরা কেবলমাত্র তাঁকেই ডাকো। সকল প্রশংসা কেবলমাত্র সেই আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের জন্যই।’ – [আল মুমিন : ৬৪-৬৫]

‘বল, দ্বীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট করে শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্যই আমি আদিষ্ট হয়েছি। সর্বপ্রথম আমাকেই আনুগত্যের মস্তক অবনত করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। … বল, আমার দ্বীনকে আল্লাহর জন্য একান্তভাবে নির্দিষ্ট করে আমি শুধু তাঁরই আনুগত্য-দাসত্ব করবো। তোমরা অবশ্য তাকে পরিত্যাগ করে যাকে ইচ্ছা তার গোলামী করেও বেড়াতে পারো … (তবে) যারা তাগুতের (অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘনকারী) দাসত্ব ত্যাগ করে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে, তাদের জন্যই রয়েছে সুসংবাদ।’-[আয-যুমার : ১১-১৭]

‘আমরা তোমাদের প্রতি সঠিক গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি। সুতরাং আল্লাহর জন্যে দ্বীনকে খালেছ করে কেবল তারই ইবাদত কর। সাবধান, দ্বীন একনিষ্ঠভাবে কেবল মাত্র আল্লাহর জন্যই নিবেদিত ও নির্দিষ্ট।’ – [আয-যুমার : ২-৩]

‘আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। দ্বীন একান্তভাবে তাঁর জন্যেই নিবেদিত। তবুও কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে তোমরা ভয় করবে ?’- [আন-নাহাল : ৫২]

‘তারা কি আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে দ্বীন তালাশ করে? অথচ আসমান-জমিনের প্রতিটি বস্তু ইচ্ছায় হোক-অনিচ্ছায় হোক আল্লাহরই নির্দেশ মেনে চলছে। আর তারই কাছে সবাইকে ফিরে যেতে হবে।’-[আল ইমরান : ৮৩]
‘শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য নির্দিষ্ট নয়। তাঁরই নির্দেশ, তিনি ব্যতীত আর কারো আনুগত্য-দাসত্ব-বন্দেগী করো না। এটাই সত্য-সঠিক দ্বীন।’ – [ইউসুফ : ৩০]

‘আনুগত্যব্যবস্থাকে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য খালেছ করা ব্যতীত তাদেরকে অন্য কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি।’-[আল বায়্যিনাহ : ]
এমনিভাবে দ্বীন বলতে কোরআনের বিধি-বিধানকেও বলা হয়েছে। যেমন :

  • ‘ব্যভিচারী আর ব্যভিচারীনী উভয়কে একশো চাবুক মারো। আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে তোমরা যেন তাদের উপর দয়া না কর।’ -[আন নূর : ২]
  • ‘তারা কি (আল্লাহর সাথে) এমন কিছু অংশীদার বানিয়েছে, যারা তাদের জন্য দ্বীনের অনুরূপ আইন রচনা করে; যার অনুমতি আল্লাহ দেননি ?’-[শূআরা : ২১]
  • ‘আর এমনি করে আমরা ইউসুফের জন্য পথ বের করেছি। বাদশাহর বিধানে তার ভাইকে পাকরাও করা তার জন্য বৈধ ছিল না।’ – [ইউসুফ : ৭৬]
  • পবিত্র কোরআনের ভাষায় দ্বীনকে হেদায়াত হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে। হেদায়াত অর্থ পথনির্দেশ। অর্থাৎ মানব জাতির সার্বিক প্রয়োজনকে সামনে রেখে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূলের মাধ্যমে তাঁর ঐশী প্রত্যাদেশ তথা আসমানি কিতাব বা ঐশীগ্রন্থের মাধ্যমে যে পথনির্দেশ পাঠিয়েছেন তাকেই ধর্ম, দ্বীন বা হেদায়াত বলা হয়। আল্লাহ প্রদত্ত সর্বশেষ নবী ও রাসূলের নাম হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এবং তাঁর মাধ্যমে সমগ্র মানব জাতির উদ্দেশ্যে প্রেরিত যে সবশেষ পথনির্দেশ তথা ঐশীগ্রন্থের নাম আল কোরআন। ইসলাম ধর্ম বলতে এই আল কোরআনের পথনির্দেশ এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জীবনাদর্শকেই বুঝায়।

চলবে-

Comments

Popular posts from this blog

ক্যারিয়ার গাইড: টেলিসেলস এক্সিকিউটিভ/কাস্টমার সার্ভিস রিপ্রেজেন্টেটিভ বা গ্রাহকসেবা প্রতিনিধি

যৌবনের যত্ন [চার]: পুরুষ হরমোন ঘাটতির ১০টি লক্ষণ

যৌবনের যত্ন [তিন]: পুরুষদের দেহে টেস্টোস্টেরনের প্রভাব